রপ্তানিসহ বড় চ্যালেঞ্জে পড়বে ওষুধশিল্প
এলডিসি উত্তরণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হবে বাংলাদেশ। গত আট বছরের নানা প্রক্রিয়া ও একাধিক মূল্যায়ন শেষে এমন সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের। সেই হিসাবে এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সামনে সময় ১৫ মাস। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এলডিসি উত্তরণ পেছানো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। গত মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ২০২৬ সালেই এলডিসি থেকে উত্তরণের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, বাংলাদেশ এখনই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নয়। এজন্য আরও তিন-পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তবে তারা গ্র্যাজুয়েশন সমর্থন করেন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি খাত সমস্যায় পড়ার পাশাপাশি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এতে ওষুধের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া সফটওয়্যার, বইসহ বিভিন্ন পণ্যের কপিরাইট ইস্যুতে বাড়তি টাকা খরচ হবে। মেধাস্বত্ব নিয়েই দুশ্চিন্তা বেশি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, নির্ধারিত সময়েই এলডিসি উত্তরণ হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বহুবার বৈঠক করেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, তিন বছর পিছিয়ে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে এলে কি বিদ্যুৎ সমস্যা, যানজট সমস্যা ইত্যাদি সমাধান হয়ে যাবে? বৈশ্বিক রাজনীতি এখন খুবই টালমাটাল- এটা মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। এলডিসি উত্তরণের সময় পেছানোর জন্য বাংলাদেশের যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয় এই কারণ দেখিয়ে সময় পেছানো যাবে না। বাংলাদেশের এখন সব মনোযোগ দেওয়া উচিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলে (এসটিএস)। এ জন্য শিল্প উৎপাদক, ওষুধ খাত ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করা উচিত। তিনটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার- এক. অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা; দুই. শ্রম ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; তিন. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণে মসৃণ উত্তরণ কৌশল গ্রহণ করেছিল সরকার। গত বছর আগস্টে বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। এরপর অর্থনীতিতে কিছু সংস্কার হয়েছে। তবে এক বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেড়েছে। ব্যাংক খাতেও কিছু সংস্কার হয়েছে, যার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ওই খাতে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ফলে এলডিসি উত্তরণের সময় পেছাতে গেলে বাংলাদেশ কী কারণ দেখাবে, সেটা প্রমাণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণপ্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত ৬ বছরে এ প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশকে আরও দুই বছর সময় দেওয়া হয়। গত ১৩ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে সিদ্ধান্ত হয়, ২০২৬ সালে নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এ নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এখন এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদ-ের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পায় বাংলাদেশ ২০২১ সালেই। কিন্তু করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য দুই বছর সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ এবং এলডিসিভুক্ত হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য-সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে না। এলডিসি উত্তরণ পেছানোর আবেদনের দুটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো, সরকারপ্রধানকে সরাসরি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) প্রধানের কাছে চিঠি লিখে যুক্তি দেখাতে হবে যে নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নতুন ও অপ্রত্যাশিত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন উত্তরণ পেছানো ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আবেদন পেলে সিডিপি একটি মূল্যায়ন করবে এবং ওই মূল্যায়নের ওপর পেছানোর বিষয়টি নির্ভর করবে। দ্বিতীয় উপায়টি হলো, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে। তখন সাধারণ পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভূমিকা রাখতে পারে এমন শক্তিশালী দেশের সহায়তা লাগবে এবং যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা তিনটি সূচকেই ভালো অবস্থায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক অডিটের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখাতে হবে যে, তিনটি সূচকের অন্তত দুটি উত্তরণের যোগ্যতার নিচে। আরেকটি উপায় হচ্ছে, যৌক্তিকতার ভিত্তিতে এমন প্রাক্কলন দেখাতে হবে যে, উত্তরণের পর দেশের অর্থনীতি তিনটি সূচক নির্ধারিত মানদ-ের নিচে নেমে যাবে। এটি দেখানোও সহজ হবে না। আর ডিউটি ফ্রি সুবিধা উত্তরণের পরও তিন বছর পাওয়া যাবে। ফলে এখন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। সামনে প্রলয়ংকরী কোনো কিছু না হলে সূচক নিচে নামবে না। ধাক্কা লাগবে এটা মনে করে পেছানো সম্ভব নয়। বাস্তবতা মেনে নেওয়া দরকার।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে বাংলাদেশ উচ্চ বৈদেশিক ঋণ, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পতন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় নিট এফডিআই কমেছে ১৩ শতাংশ। এ প্রেক্ষাপটে আমরা এলডিসি উত্তরণের জন্য তিন-পাঁচ বছরের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ওষুধশিল্পসহ রপ্তানির বহুমুখীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতেও প্রভাব ফেলবে। কারণ উত্তরণের পর ডব্লিউটিওর ট্রিপস ওয়েভার হারানোয় কড়াকড়ি মেধাস্বত্ব নিয়ম মেনে চলতে হবে; বিশেষত উচ্চমূল্যের ক্যানসার চিকিৎসা ও বায়োটেক ওষুধের ক্ষেত্রে। এ পরিবর্তনে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পণ্যের পরিসর সংকুচিত হবে এবং গবেষণা-উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তিতে ভারী বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে।