রাজধানীতে মাসে ৬০৯টি ডিভোর্স!
বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন অনার্স চতুর্থ বর্ষ পড়ুয়া জান্নাত (ছদ্মনাম)। পাত্র ছিলেন কম্পিউটার প্রকৌশলী। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস বেশ হাসি-আনন্দেই কাটে। এরপর বাজে ভাঙণের সুর। ছোট-খাটো অশান্তি একময় ধারণ করে বড় আকার। জান্নাত চলে যান বাবার বাড়ি। বিয়ের বছর না ঘুরতেই জান্নাতের কোল আলো করে সন্তান এলেও দেখতে যাননি তার স্বামী। এমনকি শশুরবাড়ির লোকেরা অস্বীকার করে বসে জান্নাতের সন্তানকে। শেষ পর্যন্ত তাই পরিবারের সমর্থনে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠান জান্নাত।
এমনকি দীর্ঘদিনের যে সংসার তারও কিছু পরিণতি গড়াচ্ছে ডিভোর্স-এ।
এমনই দম্পতি ছিলেন পারুল (ছদ্মনাম) ও হাসান (ছদ্মনাম)। তাদের ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটে ডিভোর্স-এর মাধ্যমে। স্কুলশিক্ষক পারুল আর ব্যবসায়ী হাসানের বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে মতের অমিল একসময় তিক্ততায় রুপ নেয়। তাদের বড় সন্তান স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছে। ছোট সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। এরই মাঝে একে অপরের গায়ে হাত তোলার ঘটনা ছিলো নিত্যদিনের। শত চেষ্টায়ও বনিবনা না হওয়ায় পারুলকে ডিভোর্স-এর নেটিশ পাঠান হাসান।
পরিসংখ্যান বলছে রাজধানীতে প্রতিবছর ডিভোর্স-এর হার বাড়ছে। খোদ ২০২৪ সালেই রাজধানীতে প্রতি মাসে ৬০৯টি ডিভোর্স-এর নোটিশ পাঠানো হয়েছে। কারণ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, নারীর শিক্ষা, আত্মনির্ভরশীলতা, পারিবারিক সহিংসতা, নারী-পুরুষের স্বাধীন থাকার প্রবণতা অন্যতম।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৪৮ হাজার ৩৬৯টি। এর মধ্যে পুরুষের পাঠানো নোটিশের সংখ্যা ১২ হাজার ২৯৯ এবং নারীর পাঠানো নোটিশের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৭০টি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ২০২১ সালে নারী কর্তৃক ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ১১৩টি। আর পুরুষ পাঠিয়েছে ২ হাজার ৬২টি নোটিশ। ২০২২ সালে নারী কর্তৃক পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ৩৮৩টি নোটিশ। পুরুষ পাঠিয়েছে ২ হাজার ৩১৫টি। ২০২৩ সালে নারী কর্তৃক নোটিশ পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ২৮৭ টি। পুরুষ পাঠিয়েছেন ২ হাজার ২০ টি। ২০২৪ সালে নারী কর্তৃক পাঠানো হয়েছে ৫ হাজার ৭৬৪ টি নোটিশ। পুরুষ পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৫৪৮টি নোটিশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের (সাবেক) অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব আমাদের সময়কে বলেন, ‘বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনাচারণেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। ডিভোর্স বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পাল্টেছে। আগে এটাকে কলঙ্ক হিসেবে দেখা হলেও এখন সেটাকে মেনে নিয়েছে সমাজ।’
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
মানুষের মাঝে এখন ডিভোর্স-এর পরও যে আত্মনির্রশীল হয়ে বাঁচা যায়, নিজের সুখ, আত্মসম্মানকে প্রাধান্য দিয়েও ভালো থাকা যায় এমন একটা ভাবমূর্তি তৈরী হয়েছে। এ বিষয়গুলো ডিভোর্স-এর হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেছেন এ সমাজবিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর আাইনজীবি ইশরাত হাসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘মেয়েরা আগে নিতান্তই ডিভোর্স দিতে পারতো না কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলো না। নির্যাতন সহ্য করে সংসার করে যেতো। এখন নারীরা চিন্তা করছে অন্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে ডিভোর্স দিয়ে আলাদা থাকাটাই ভালো।’
বিষয়টিকে ইতিবাচক উল্লেখ করে এ আনইনজীবী বলেন, ‘নারী পুরুষ উভয়েই ভাবছে একসাথে থেকে মারামারি-খুনোখুনি করে মামলা মোকদ্দমায় না গড়িয়ে শান্তিতে থাকাটাই শ্রেয়।’
কীভাবে ডিভোর্স-এর হার কমানো যায় এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুখ বুজে সহ্য করার দিন আর নেই। সংসার এখন সমঅধিকার ও সমমর্যাদার স্থান। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করলে দু’জনের মাঝে তৈরি হবে সমঝোতা, যা সবার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।