মৌসুমেও চাল কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে
দেশে সর্বাধিক ধান উৎপাদনশীল সময় বোরো মৌসুম। মোট উৎপাদনের বড় অংশই আসে এ মৌসুম থেকে। চলতি বছর বোরোতে সন্তোষজনক উৎপাদন হয়েছে। এতে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় চালের দাম প্রথম দিকে কিছুটা কমলেও পরে আবার বেড়ে গেছে। ফলে ভরা মৌসুমেও চালের পেছনে ভোক্তাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। এমনকি গত বছরের এই সময়ের চেয়েও অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সরু, মাঝারি কিংবা মোটা চাল- সব ধরনের চালের দামই এখন সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছরের এমন সময় খুচরায় সরু চালের কেজি সর্বনিম্ন ৬০ টাকাতে কেনা গেলেও বর্তমানে ৭৫ টাকার নিচে মিলছে না। গত বছরের চেয়ে বর্তমানে এই চাল ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি চালের ক্ষেত্রে ব্যবধানটি আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আর মোটা চাল কিনে খেতে হচ্ছে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে। এ হিসাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে বছরের ব্যবধানে চালের মূল্য এবং ভোক্তার ওপর খরচের চাপ কতখানি বেড়েছে।
গতকাল মালিবাগ বাজারে আসা একজন ক্রেতা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শাহ আলম বলছিলেন, গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মিনিকেট চাল ৮০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ এখন চালের মৌসুম চলছে। এ সময়ে কেন এত দামে বিক্রি হবে। মাঝারি চালের দামও বাড়তি। চালের বাজারে এ নৈরাজ্য বন্ধ করা দরকার। এ বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. রুবেল হোসেন বলেন, মিনিকেটের কেনা দামই পড়ছে সর্বনিম্ন ৭৫ টাকা। খুচরা যা ৮০ টাকার নিচে বিক্রি করা যাচ্ছে না। গত এক মাস ধরেই এ দামে বিক্রি হচ্ছে।
ধান-চালের বাজারে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন চক্র নানা কায়দায় কারসাজি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিলেও এদের ঠেকাতে সরকার ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, তদারকিতে ঘাটতি ও জবাবদিহিতা না থাকায় ভালো উৎপাদন কিংবা আমদানি করেও লাভ হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, আমদানির অনুমতি দেওয়া হলো। অথচ যারা আমদানির অনুমতি নিয়েছিল তারা আমদানি করল না। তারা কেন করল না, করলেও কোথায় মজুদ করেছে, কি পরিমাণ সরবরাহ করেছে- কোনো জবাবদিহিতা নেই। মনিটরিং মানে কেবল বাজারে গিয়ে অভিযান করা নয়। সবকিছুর ওপর, সব তথ্য-উপাত্তে সরকারের নজরদারি-তাদরকি থাকতে হবে। সব স্তরে জবাবদিহি থাকতে হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
জেলা পর্যায়ে ধান-চালের বাজারে নজরদারির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে ক্যাব সহসভাপতি আরও বলেন, প্রশাসনের ভূমিকাও দুর্বল। এর সুযোগ নিয়ে বারবার একই কায়দায় চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে অসাধু চক্র। অতীতে যারা সক্রিয় ছিল, তারা এখনও রয়ে গেছে। বোরো মৌসুমে যেখানে দাম কমার কথা, সেখানে উল্টো বেড়েছে। চালের বাজার এখন করপোরেটরা নিয়ন্ত্রণ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিপুল মজুদের সক্ষমতা আছে করপোরেট মিলগুলোর। তারা কৃষকের কাছ থেকে কিনে মজুদ করছে। পরে তা বেশি দামে বিক্রি করছে। সরকার এগুলো ঠেকাতে পারছে না।
চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে সরু চালের সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হলেও এখন তা কেটেছে। বর্তমানে সরবরাহে ঘাটতি নেই। তার পরও ঠিক কি কারণে অত্যধিক দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে, তার সদুত্তর দিতে পারছেন না কেউই। চাল ব্যবসায় জড়িতরা এর পেছনে বেশকিছু কারণের কথা জানান।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি বিক্রেতা মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, চাহিদা-জোগানের সূত্র মেনে নয়, চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আগে বড় মিলগুলো দাম বাড়াত, তাদের দেখাদেখি বাকিরা বাড়িয়ে দিত। এখন এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো। তারা বেশি পরিমাণে ধান সংগ্রহ করায় বাজারে আধিপত্য বেড়েছে। সেই সঙ্গে ধানের বাজারেও রয়েছে একশ্রেণির অসাধু চক্র, তারাও বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। আর চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন। যা অর্জিত হয়েছে। অধিদপ্তরের সরেজমিন শাখা বলছে, এবার আবহাওয়াসহ সবকিছু অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে, উৎপাদনও সন্তোষজনক। চাল ব্যবসায়ীরাও বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বোরো মৌসুমে যে ফলন হয়, তাতে চালের দাম কমে। নতুন চাল উঠলে স্বস্তি মেলে। কিন্তু এবারের চিত্রপট ভিন্ন।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বলেন, চালের দাম বৃদ্ধি বা কমা এখন আর মৌসুম কিংবা ফলনের ওপর নির্ভর করে না। ভালো উৎপাদন বা আমদানি কোনো কিছুই প্রভাব ফেলে না। ধান-চালের ব্যবসায়ীরা যেভাবে চালায়, সেভাবেই চলে। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘদিন।
কথা হলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লায়েক আলী বলেন, ধানের দাম বাড়লে তো কৃষকদের পাওয়ার কথা। সেটা হলে তো ভালোই হতো। কিন্তু একশ্রেণির অবৈধ মজুদদার ধান মজুদ করে বেশি দামে বিক্রি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। এসব মজুদদারের কোনো কাগজপত্র নেই। তারা নীতিমালার তোয়াক্কা করে না। এদের কারণেই ধানের দাম হঠাৎ ওঠানামা করে। যা প্রভাব ফেলে চালের বাজারে।