‘ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা মরে গেলাম’
‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম, কারণ আমি একা যদি মরে যাই তাহলে, আমার স্ত্রী-সন্তানরা কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম, ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, ভালোই হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না...।’
স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মিনারুল ইসলাম (৩৬) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার আগে এই নোট লিখেছেন। আজ শুক্রবার তাদের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় উত্তরপাড়া গ্রামে মিনারুলের নিজ বাড়ি এ ঘটনা ঘটে। তবে শুক্রবার সকালে বিষয়টি জানাজানি হয়।
মিনারুল পেশায় একজন দিনমজুর। তার স্ত্রী মনিরা খাতুন (৩২), তাদের ছেলে মাহিম (১১) ও দেড় বছরের শিশুকন্যা মিথিলা।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয়রা ভীড় করছেন মিনারুলের বাড়িতে। তখনো বাড়ির একটি কক্ষে ঝুলছিল মিনারুলের মরদেহ। তার কক্ষের বিছানায় পড়েছিল ছেলে মাহিমের মরদেহ। আর পাশের কক্ষের বিছানায় পড়েছিল স্ত্রী মনিরা ও শিশু মিথিলার মরদেহ। বাড়ির ভেতরে বাইরে অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে বিলাপ করছেন, মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী। তিনি আমাদের সময়কে জানান, ৭-৮ বছর আগে, মিনারুলের ঋণ পরিশোধের জন্য তিনি জমি বিক্রি করেন। জমি বিক্রি করে তার ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু মিনারুল পরে আর ঋণগ্রস্ত ছিল কিনা তা জানেন না। আজ সকালে মিনারুলসহ অন্যদের ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাননি। পরে মই দিয়ে উঠে দেখতে পান ঘরের মধ্যে মিনারুলের মরদেহ ঝুলছে।
মিনারুলের শাশুড়ি আনসুরা বেগম জানান, তার মেয়ের সঙ্গে মিনারুলের কোনো ধরনের কলহ্ ছিল না। তারা পরিবার নিয়ে ভালো ছিলেন। কিন্তু কেন এ ঘটনা ঘটলো তা জানেন না।
স্থানীয়রা জানান, মিনারুল একসময় জুয়া খেলতেন। এতে তিনি অনেক টাকা ঋণ করেন। কখনো ভ্যান চালাতেন। আবার কখনো দিনমজুরের কাজ করতেন। তবে অনেক সময় দু’বেলা খাবারও জুটতো না তাদের।
পারিলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সুজন কবির বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে ২৭০০ টাকা কিস্তি দিতে হতো মিনারুলকে। এর আগে কিডনি বিক্রি করতেও গিয়েছিলো। আমরা যেটুকু জানি, সে কৃষিকাজ করত এবং জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল।
পারিলা ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোর্শেদ বলেন, ‘এর আগে দেনা পাওনা হয়েছিল। ওর বাবা জমি বিক্রি করে পরিশোধ করে। তিনদিন আগে মিনারুল আমার কাছে গিয়ে বলে, বাড়িতে খাবার নাই। টাকা দেন। আমি দুই হাজার টাকা দিয়েছিলাম।
এদিকে, পুলিশ ওই বাড়ি থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ ধারণা করছে, চিরকুটটি মিনারুলের লেখা। চিরকুটে ঋণের দায়ে ও খাওয়ার অভাবে স্ত্রী ও সন্তাদের হত্যার পর আত্মহত্যার কথা লেখা আছে।
চিরকুটের এক পাতায় লেখা আছে, ‘আমি মিনারুল নিচের যে সব লেখা লেখবো। সব আমার নিজের কথা লিখে যাচ্ছি। কারণ, আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাবো। এই মৃত্যুর জন্য কারো কোনো দোষ নেই। আমি মিনারুল, প্রথমে আমার স্ত্রীকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিমকে (ছেলে) মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে (মেয়ে) মেরেছি। তারপর আমি নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি।’
আরো লেখা আছে, ‘আমাদের চারজনের মরা মুখ যেন বাপের বড় ছেলে ও তার স্ত্রী-সন্তান না দেখে এবং বাপের বড় ছেলে যেন জানাজায় না আসে। আমাদের চার জনকে কাফন দিয়ে ঢাকতে আমার বাবা যেন টাকা না দেয়। এটা আমার কসম।’
চিরকুটের অপর পাতায় লেখা আছে, ‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম, কারণ আমি একা যদি মরে যাই তাহলে, আমার স্ত্রী-সন্তানরা কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমারা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম সেই ভাল হলো। কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না। আমার জন্যে কাউকে মানুষের কাছে ছোট হতে হবে না। আমার বাবা আমার জন্য অনেক মানুষের কাছে ছোট হয়েছে, আর হতে হবে না। চিরদিনের জন্য চলে গেলাম।’
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মিনারুল আত্মহত্যা করেছে। সুইসাইডাল নোটটি মিনারুলের নিজের হাতের লেখা। তবে এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে।’
উল্লেখ্য, শুক্রবার দুপুরের চারটি মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠায় মতিহার থানা পুলিশ। এর আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে।