রাজনৈতিক রেষারেষিতে সচিব নিয়োগ হচ্ছে না

তাওহীদুল ইসলাম
১৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনৈতিক রেষারেষিতে সচিব নিয়োগ হচ্ছে না

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম চলছে সচিব ছাড়া। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। সচিবের পদ দীর্ঘদিন খালি থাকায় মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, সচিব পদে নিয়োগ দিতে না পারার বড় কারণ দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে সিদ্ধান্তহীনতা। অতিরিক্ত সচিব থেকে সচিব হওয়ার জন্য অনেক কর্মকর্তা আগ্রহী। ফ্যাসিস্ট আমলে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তাও আছেন। আবার কোনো দলীয় পরিচয় নেই এমন কর্মকর্তাও আছেন। কিন্তু রাজনৈতিক রেষারেষির ফলে কেউই নিযুক্ত হতে পারেননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে পছন্দের কর্মকর্তাদের সচিব নিয়োগের সুপারিশ আসছে। এর বাইরে রয়েছে পদোন্নতিসংক্রান্ত সিন্ডিকেট। এসব ম্যানেজ করে সচিব হতে পারা কঠিন বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বিপাকে আছেন সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তারা। অনেক রাজনৈতিক দল পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচনের আগে সচিব করা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে। প্রশাসনে ‘নিজেদের’ লোক চায় তারা। ওদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি চক্র পদোন্নতি-পদায়নে ভূমিকা রাখেন বলে শোনা যাচ্ছে। কিছু কর্মকর্তা এখন দলীয় পরিচয় বহন করে পদোন্নতির জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। কতিপয় কর্মকর্তা রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজতে সক্রিয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী পরিচয়টাই বড় করে দেখার কথা, কিন্তু ফের রাজনৈতিক প্রভাব সামনে চলে আসছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান ড. মো. মোখলেস উর রহমান। এরপর আগের সরকারের ফিটলিস্টে থাকা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক পদায়নের ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকজন পদায়ন হওয়া জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ডিসি নিয়োগে বিতর্কের পরবর্তী সময়েও মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি-পদায়ন বিতর্কের জন্ম দেয়।

স্বৈরাচারী সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল, পদোন্নতি ও পদায়নে সক্রিয় হয় একটি চক্র। তাই বিতর্ক এড়াতে সতর্ক থাকার চেষ্টা করছে সরকার। গত এক বছরে ৭৮৫ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২৯ জন কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসর। বিতর্কের মুখে অনেক সচিবকে সরিয়ে দিতে হয়েছে। এসব কারণে এবার সচিব নিয়োগে সরকার হিমশিম খাচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রসঙ্গে ড. মোখলেস উর রহমান সম্প্রতি বলেছেন, এ নিয়ে কাজ চলছে। এর বেশি মন্তব্য করা যাবে না।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয় গত ২২ জুলাই। এরপর থেকে পদটি শূন্য। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে ড. খ ম কবিরুল ইসলামের শেষ কর্মদিবস ছিল গতকাল। এমন অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শূন্য রয়েছে। কিছু স্থান খালি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। গত ৩০ জুলাই দুজন অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি পেয়ে সচিব হয়েছেন। এর মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুন নাসের খানকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পদায়ন করা হয়েছে। মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) তসলিমা কানিজ নাহিদাকে বাংলাদেশ সরকারি কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে পছন্দের সচিবকে পদায়ন না করায় পদায়ন হওয়া দুজন সচিবকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে দেননি দুজন উপদেষ্টা।

হাসিনা আমলের ১৭ সচিব এখনও বহাল রয়েছে। তারা হলেন- অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, অর্থ বিভাগের সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রুহুল আমিন, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সচিব আমিন উল আহসান, বিপিএটিসির রেক্টর সাঈদ মাহবুব খান, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোকাব্বির হোসেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমির রেক্টর ড. মো. ওমর ফারুক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিফা খান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংযুক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহমুদুল হোসাইন খান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফ।

সূত্রমতে, গত এক বছরে উপসচিব পদে ১৪১, যুগ্ম সচিব পদে ৪২৪, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৪৯, গ্রেড-১ পদে ২৬ এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদে ৪৫ জনসহ সর্বমোট ৭৮৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে ৪, যুগ্ম সচিব পদে ৭২, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮, গ্রেড-১ পদে ৪১ এবং সচিব পদে ১১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এক বছরে অতিরিক্ত সচিব পদের ১৯, গ্রেড-১ পদের একজন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের নয়জনসহ সর্বমোট ২৯ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে উপসচিব পদের ১৬, যুগ্ম সচিব পদের ১৫, অতিরিক্ত সচিব পদের ৭৫, গ্রেড-১ পদের ৩৪ এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের ২৪ জনসহ সর্বমোট ১৬৪ জন কর্মকর্তা কর্মকাল শেষে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন।