মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক করা হলো না রুপলালের
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল শনিবার রাত ৯টায় সয়ার ইউনিয়নের বুড়িহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন রুপলাল (৪৩) ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপ (৪২)। রূপলাল উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর ডাঙাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পেশায় ছিলেন একজন মুচি। দীর্ঘদিন তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। ভাগ্নি জামাই প্রদীপের বাড়ি মিঠাপুকুর উপজেলার গোপালপুর ছড়ান গ্রামে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতদের পরিবার জানায়, রূপলালের মেয়ে নুপুর এ বছর এসএসসি পাস করেছে। আজ রবিবার তার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হওয়ার কথা ছিল। মুচি সম্প্রদায়ের বিয়েতে বা কোনো উৎসবে বাংলা মদ পরিবেশন এক ধরনের রীতি রয়েছে। তাই গতকাল রূপলাল ও প্রদীপ সৈয়দপুরে ভাটিখানা থেকে ব্যাগে করে বাংলা মদ সংগ্রহ করে ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছিলেন।
উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট এলাকার ফরিদাবাদ মোড়ের কাছে বটতলা নামক স্থানে রাত ৮টার দিকে পৌঁছালে কয়েকজন যুবক তাদের অনুসরণ করে ব্যাগে কী আছে জানতে চায় এবং মদ ভর্তি ব্যাগটি কেড়ে নেয়। এরপর তারা চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করে। পরে স্থানীয় জনতারা তাদের চোর সন্দেহে মারধর শুরু করে। স্থানীয় জনতার মারধরে রুপলাল ও প্রদীপের অবস্থা খারাপ হলে তাদেরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বুড়িরহাট স্কুল মাঠে ফেলে রেখে যায়। রূপলালের সেখানেই ৯টার দিকে মৃত্যু হয়। আহত প্রদীপকে পুলিশ উদ্ধার করে প্রথমে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি করালে আজ ভোর ৪টায় তারও মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় এলাকায় যৌথবাহিনী টহলে রয়েছে। তবে কাউকে আটক করা হয়নি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত শুরু করেছে।
নিহত রুপলাল দাসের স্ত্রী মালতী রাণী দাস বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমার স্বামী ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার স্বামী কোনোদিন চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। কেন মারল আমার স্বামীকে, আমি এর বিচার চাই। আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে যেতে পারল না আমার স্বামী। আমি আমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখন কেমন করে জীবনযাপন করব? কে আমাদের খাওয়াবে এখন? দেশে কি কোনো বিচার নাই? আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
রুপলাল দাসের বৃদ্ধা মা রাছিয়া দাস বলেন, ‘আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে ওরা। আমার ছেলের কোনো দোষ নেই। আমার ছেলে জুতা সেলাইয়ের কাজ করে খায়। তার যে টাকা আয় হয় সে টাকাতেই তার সুন্দরভাবে জীবনযাপন চলছিল। আমার নাতনীর বিয়ের কথা চলছে। আমার ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেতে পারল না। আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে। রুপলাল আমার একমাত্র ছেলে। আমি স্বামীকে হারিয়েছি। এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটুকুকে হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে গেলাম। আমার ছোট ছোট নাতি-নাতনীরা বাবা হারা হয়ে গেল এই অল্প বয়সেই। আমার ছেলেকে তারা কেন মারল আমি দেশবাসির কাছে বিচার চাই।’
রুপলাল দাসের ১২ বছর বয়সী জয়দাস নামের ছেলে বলেন, ‘আমার বাবাকে কেড়ে নিল ওই দুর্বৃত্তের দলেরা। আমাকে বাবাহারা করল, যারা আমি তাদের বিচার চাই। আমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসত। বাবা খুব কষ্ট করে সৎ পথে আমাদের খাওয়াতেন। ওরা নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। ওদের শাস্তি চাই আমি।’
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ‘রুপলাল দাসের স্ত্রী মালতী রাণী দাস বাদি হয়ে তারাগঞ্জ থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।’