শিশুর জন্য মায়ের দুধ কেন দরকার
মায়ের দুধ শিশুর জন্য সর্বোত্তম পুষ্টি। এটি শিশুকে করে তোলে সুস্থ, সজীব ও রোগপ্রতিরোধক্ষম এবং গড়ে তোলে একটি মজবুত ভবিষ্যতের ভিত্তি। শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। এর গুরুত্ব তুলে ধরা এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য ওয়ার্ল্ড ব্রেস্টফিডিং ট্রেন্ডস ইনিশিয়েটিভ (ডব্লিউবিটিআই) প্রতিবছর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ হিসেবে সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হয়। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো : ‘টেকসই সহায়তাব্যবস্থা তৈরি করুন’, যা বোঝায়- শুধু সচেতনতাই নয়, শিশুকে দুগ্ধপানে চাই মায়েদের সহায়ক পরিবেশ।
শিশু জন্মের পর মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে, এটিকে শালদুধ বলা হয়। মায়ের দুধ শিশুর অধিকার। জন্মের পর শিশু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পুষ্টির দরকার, এর সবই মায়ের দুধে আছে। তাই মায়ের বুকের দুধই শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার। শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৈহিক গঠনে মায়ের দুধের অপরিহার্যতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। মায়ের বুকের দুধে ল্যাকটোজ নামক বিশেষ এক ধরনের শর্করা আছে, যা শিশুর শরীরে উপকারী ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করে। এটি শিশুর হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শিশুর প্রথম পুষ্টির জোগানও আসে মাতৃদুগ্ধ থেকেই।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু হাসপাতালে কর্মরত ডা. উম্মে হাবিবা বলেন, ‘অন্য যে কোনো বিকল্প দুধের চেয়ে মায়ের দুধের পুষ্টিগুণ বহুলাংশে বেশি। একটি শিশু জন্মের সময় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) মস্তিষ্ক কোষ নিয়ে আসে, যার ৯৫ শতাংশ সংযোগ হয় জন্মের প্রথম তিন বছরে। এই সময়টিতে মায়ের দুধ শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিমিত প্রোটিন, ভিটামিন ও রোগপ্রতিরোধ উপাদানের সংমিশ্রণে বুকের দুধ শিশুর জন্য সবচেয়ে আদর্শ খাবার।’
আরও পড়ুন:
শীতে গর্ভবতী মায়েদের যত্ন
শালদুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী প্রাচীর হিসেবে কাজ করে। ফলে শিশুর শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য রোগজীবাণু প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। অ্যান্টিবডিতে পূর্ণ শালদুধ শিশুর বুক ও কানের প্রদাহ, ডায়রিয়া, অ্যাজমা, অ্যাকজিমা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করে এবং দাঁত ও হাড় মজবুত রাখে। জন্মের পর শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বুকের শালদুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে। একজন নিকটাত্মীয় বা নার্স এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন। জরুরি নবজাতক ও মাকে একই বিছানায় রাখা- যেন শিশু মায়ের সান্নিধ্য থাকে। শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যে পুষ্টি প্রয়োজন, তার সবকিছুই থাকে মায়ের দুধে। শিশুর দ্রুত বৃদ্ধি, শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দৈহিক গঠনে মায়ের দুধের অপরিহার্যতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
তবে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, দেশে ৪৫ শতাংশ শিশু মায়ের বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলছে। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ সালে ৬৫ শতাংশ শিশু মায়ের দুধ পেলেও বর্তমানে এই হার কমে ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়ণ, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অফিসে ‘ব্রেস্টফিডিং কর্নার’-এর অভাব এবং বাজারে ফর্মুলা দুধের প্রচারণাই এর মূল কারণ।
আমাদের সুস্থ শিশু ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো এবং ঘরে তৈরি পরিপূরক খাবার খাওয়ানোর হার বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে গুঁড়া দুধ বা কৌটাজাত শিশুখাদ্যের ব্যবহার ও বিজ্ঞাপন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গুঁড়া দুধের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে মায়ের দুধের পক্ষে সচেতনতা তৈরিতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মায়ের বুকের দুধ শিশুর অমৃত, সঞ্জীবনী। শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর জন্য মাকে পরিবারের সবাই মিলে সহযোগিতা করতে হবে।