সন্তানের জন্য মা
বিখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন বলেছিলেন, ‘কোনো একটি বিষয় মায়েদের দুবার ভাবতে হয়। একবার তার সন্তানের জন্য, আরেকবার নিজের জন্য।’ জন্মদাত্রী ‘মা’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার মতো পৃথিবীতে আর কে আছে আপন! সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে তাকে পৃথিবীর আলোতে আনা, লালন-পালনসহ সব দায়িত্বভারই মায়ের ওপর ন্যস্ত থাকে। সন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে মায়ের যে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম হয়, অনেক পরিবারের কাছেই সেসবের কোনো মূল্য থাকে না। মায়ের মূল্যায়ন তো নেই-ই বরং শিশুসন্তানের কোনো ভুল কিংবা পরিণত বয়সের যেকোনো অপরাধের জন্য সমাজ-পরিবার সেই মাকে দোষ দিতে থাকে। দুই দশক আগেও কন্যাসন্তান জন্মদানের জন্য মাকেই দোষারোপ করা হতো। অথচ সন্তান কিন্তু বাবা-মায়ের দুজনের।
সন্তান ধারণ করার জন্য মায়ের শারীরিক ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। প্রায় নয় মাস কঠোর সাধনার পর মা তার সন্তানকে পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসেন। এই সময়ে মায়ের নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। একজন মা এই সময় অপরিসীম কষ্টসহিষ্ণুতার পরিচয় দেন। সন্তান যখন গর্ভে আসে, তখন থেকে মায়ের মনে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার জন্ম হয়। মা জন্মদায়িনী বলেই তার একান্ত পরিশ্রমে সন্তান লালিত-পালিত হয়। তাই সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়ে মাকেই বেশি ভাবনায়, উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়। মা বেশি ভাবেন আর উৎকণ্ঠায় থাকেন বলে শিশুসন্তানের যেকোনো ভুলের জন্য মাকেই পরিবারের আর দশজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের কটু কথাও শুনতে হয়। এককথায় সন্তানের সব ধরনের নেতিবাচক কাজের জন্য মাকে দোষারোপ করে সবাই। অথচ প্রচলিত কথায় বলে, ‘সন্তান যখন হাঁটতে শেখে মা তখন হাঁটা ভুলে যান- কেবল সন্তানের পথচলার পেছনে ছুটে বেড়ান’।
সন্তান যেহেতু মায়েরই নাড়িছেঁড়া ধন, তারই শরীরের অংশ, তাই তিনি সব তাচ্ছিল্য, লাঞ্ছনা, অভিযোগ প্রায় নীরবে-প্রতিবাদহীন মেনে নেন। এই মেনে নেওয়ার মধ্যে থাকে সন্তানের ভবিষ্যৎ মঙ্গল চিন্তা, থাকে তার প্রতি অগাধ স্নেহ-ভালোবাসা এবং সমাজের সঙ্গে মনোমালিন্যে না জড়ানোর সচেতন প্রয়াস। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে, এই সহিষ্ণুতা মায়ের সম্মান ও মানবিকতার চরম অবক্ষয়! সন্তান যেহেতু দুজনের তাই সন্তানের ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ সব বৈশিষ্ট্যের জন্য দুজনকেই সমানভাবে যেমন কৃতিত্ব দেওয়া উচিত, তেমনি দায়ীও করা উচিত। কারণ বাবা-মায়ের স্বভাব-চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও সন্তানের মধ্যে থাকে। সন্তানের কর্মজীবন (পধৎববৎ) গঠনে মায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে এবং সেই পথে এগিয়ে যেতে মায়ের সমর্থন ও দিকনির্দেশনা অপরিহার্য।
কিন্তু যখনই ছেলেমেয়েরা কোথাও কিছু অঘটন ঘটায়, তখনই প্রথম আঙুল ওঠে মায়েদের দিকে। যেন এটাই স্বাভাবিক। কোনো ছেলেমেয়ে যদি রাস্তায় উগ্র আচরণ করে, নোংরামি করে, বখে যায়, নেশার পথে চলে যায়, সবাই বলে, মা ঠিকমতো শিক্ষা দেননি। এই ধারণাটি বহু পুরনো। আজও বিয়ের পরে মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কোনো একটা কাজ না পারলেই প্রথম যে টিপ্পনীটা শুনতে হয় সেটা হলো, ’তোমার মা কি কিছুই শেখায়নি?’ বারবার সবাই মায়ের দিকে আঙুল তুলে সহজ সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়। না শেখালে মায়ের দোষ, এমনকি ছোটবেলায় স্কুলে বই-খাতা না আনলে বা হোমওয়ার্ক না করলে তখনও বলা হয়, তোমার মা দেখে দেয়নি সবকিছু? বাসায় মা নাই? মাকে যেন সর্বংসহা হতে হয়!
আরও পড়ুন:
শীতে গর্ভবতী মায়েদের যত্ন
সন্তানের কর্মজীবন গঠনে মায়ের ভূমিকা শৈশব থেকেই শুরু হয়, শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টা করেন, পেশা নির্বাচনে সহায়তা করেন, আত্মবিশ্বাস তৈরি করেন, সন্তানের ভালো কাজে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা জোগান। কেউ কেউ কিন্তু ছোটকালের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে চমৎকার আঁকিয়ে হয়, কেউ গান গায়। যে সাঁতার শিখেছিল, সেই সাঁতার শেখার ফলে আপাত জলের ভয়টা তো গেছে। এই গুণগুলোর জন্য কেউ কখনও মাকে বাহবা দেন না। কিন্তু, সব দোষারোপের জন্য মা আছেন।
অথচ মা যা শেখান না, যা শেখাতে চান না, সেই অকথা, কুকথা, রূঢ় ব্যবহার, অভব্য আচরণ- তার জন্যও অধম মাকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। তিনি তা মাথা নত করে মেনে নেন। কারণ, আপনি যে শিক্ষা দিয়েছেন আপনার সন্তান সেটা গ্রহণ করেছে, আপনার সন্তানটি ভালো হয়েছে। যার সন্তানটি হয়নি? তার মানে তিনি তার সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দেননি? এটা প্রমাণিত, তাই তিনিই দোষী!
কিন্তু এটা কি ঠিক? আপনি হয়তো জানেন না, আপনার মতো তিনিও চেষ্টা করেছেন। অনেক চেষ্টার পরও সফল হতে পারেননি। এই অসফলতার দায় একতরফাভাবে মায়ের ওপরই চাপিয়ে দেয়। এর প্রধান কারণ, মায়ের সরলতা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও যুক্তিহীনতা, মা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের মঙ্গল কামনায় নিজেকে নিঃশেষ করে দেন। তার অতিরিক্ত সারল্য ও স্নেহান্ধের কারণে সন্তানকে সব সময় কঠিন শাসনেও রাখতে পারেন না। সামান্য ভুল থেকে শুরু করে ভয়াবহ কোনো দোষের দায়ে মায়ের দিকেই আঙুল তোলে। মা, তুমি ভালো না। তোমার অবহেলায় আজ সন্তানের এই দশা। অর্থাৎ কোনো সন্তান কোনো কারণে যদি সামান্য বখেও যায়, কিংবা জীবনের কোনো পর্যায়ে গিয়ে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবন পার করে, তবে পরিবার ও সমাজ সবার ভ্রুকুটি মায়ের দিকেই। সন্তান যখন ভালো কোনো কাজে সফলতা পায় তখন পিতার নাম ধরে বলে- ‘কার ছেলে দেখতে হবে না!’ পরিবার, স্বজন ও সমাজ যেকোনো ভালো কাজের কৃতিত্বে ভাগীদার হতে পছন্দ করে।
অথচ কত নারী তার স্বামীর অকথ্য অত্যাচার সয়ে শুধু সন্তানের মুখ চেয়ে সংসার নামক নরকে জীবন পার করেছে। কত শত মেধাবী মায়েরা নিজের ক্যারিয়ার বির্সজন দিয়েছেন সন্তানকে সুযোগ্য করে মানুষ করবেন বলে। আমাদের চারপাশে তাকালেই দেখা যায় যে কত বাবা সন্তান ফেলে চলে গেছেন। মা কিন্তু দিনমজুরি বা পতিতাবৃত্তি করে হলেও সন্তানকে বড় করেছেন।
এমন মমতাময়ী মাকেও সমাজ বলে, তোমার কারণেই সন্তান সুশিক্ষিত হয়নি, তোমার কারণে সন্তানের জীবন স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠেনি। এমনকি শিশু প্রতিবন্ধী হলেও আঙুল মায়ের দিকেই ওঠে, কারণ সন্তান তো তুমিই গর্ভে ধারণ করেছ! আবার সন্তান যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, সুনাম অর্জন করে, তখন পরিবারের অন্য সদস্যরা মাকে সাধুবাদ জানানোরও কোনো প্রয়োজন মনে করে না। মায়ের যেন পুরোটাই থ্যাংকসলেস জব। তবে ইদানীং রাষ্ট্র ও সমাজের কিছু প্রতিষ্ঠান-সংগঠন মাকে মাঝে মাঝে রত্নগর্ভা খেতাব নিয়ে সম্মানিত করার চেষ্টা জারি রেখেছে।
সন্তানের প্রতি মায়ের অন্ধ স্নেহ-ভালোবাসাই মাকে সব দোষে দোষী করে। মা-ও মানসিকভাবে এতটা যুক্ত থাকেন যে, অনেকটা জীবনের চিরাচরিত নিয়মের মতো সব হজম করেন। কিন্তু এতে দিনের পর দিন মায়েরা মানসিক জটিলতায় ভুগতে থাকেন। তাদের সেই মানসিক জটিল অবস্থার খোঁজ পরিবারের বাকি সদস্য থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র- কেউ রাখে না। কিন্তু এমনটা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। এই নিয়মের পরিবর্তন সাধন করা একান্ত জরুরি।
আরও পড়ুন:
বিশেষজ্ঞ যা বলেন