৫ আগস্ট বিয়ানীবাজারে শেষ বিকেলে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক

বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি
০৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:১৪
শেয়ার :
৫ আগস্ট বিয়ানীবাজারে শেষ বিকেলে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক

৫ আগস্ট ২০২৪। বিয়ানীবাজারবাসীর জন্য এই দিনটি ছিল একটি আতঙ্কিত দিন। বিষাদে পরিণত হয়েছিল পৌর শহরের আশপাশ। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার খবর জানতে পেরে দুপুরে পৌরশহরে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা উল্লাসে নেমে পড়ে। কারো হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, কারো চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। কে জানতো এই আনন্দের পর তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিষাদ। পরিবার হারাবে তাদের প্রিয়জনকে। সন্তান হারাবে পিতা, স্ত্রী হারাবে স্বামী, পিতা-মাতা হারাবে তাদের সন্তান।  

দুপুরে সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল, বিয়ানীবাজার পৌর শহরে আতঙ্ক ততই বাড়ছিল। আনন্দ উল্লাস থেকে উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে গিয়ে ভাংচুর আর থানায় অগ্নিসংযোগের পর পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। শুরু হয় ইট পাটকেল নিক্ষেপ আর গোলাগুলি। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে হঠাৎ গুলির শব্দে গর্জে ওঠে পুরো শহর। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয় রাজপথের বিজয় উল্লাস। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তারেক আহমদ, ময়নুল ইসলাম ও রায়হান হোসেন নামে ৩ জন তরুণের নিথর দেহ। গুলিবিদ্ধ হন দুবাগের নাজমুল ইসলাম তাজিম চৌধুরীসহ অনেকে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষী।

শহীদ তারেক আহমদের মা ইনারুন নেসা বলেন, ‘দেখতে দেখতে আজ আমার ছেলেকে হারানোর একটি বছর হয়ে গেছে। আমার সন্তানকে হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। কি করে এই দিনের কথা ভুলে যাব। ছেলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে সেটা শুনে একজন মায়ের অবস্থা যে কি রকম হয় সেটা বুঝাতে পারব না। আজকের এই দিনেই আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি।’

শহীদ ময়নুল ইসলামের স্ত্রী শিরিন বেগম বলেন, ‘কে জানতো বিজয় উল্লাসে যাওয়াটাই ছিল শেষ যাওয়া। আমার স্বামী আর কখনো আমাদের মাঝে আর ফিরে আসবেন না। আজকের এই দিন অন্যান্য মানুষের কাছে কি সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমাদের কাছে একটা কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। কারণ, আমার সন্তানরা তাদের বাবাকে হারিয়ে এতিম আজকের দিনে। সুতরাং আমরা আজকের দিনকে কখনো ভুলতে পারব না।’

নিহতদের মধ্যে কলেজ শিক্ষার্থী রায়হান উদ্দিনকে (১৮) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। তিনি পরিবারের সঙ্গে বিয়ানীবাজার পৌরসভার পূর্ব নয়া গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতেন। অপর নিহত বিয়ানীবাজার পৌরসভার পূর্ব নয়াগ্রামের ময়নুল ইসলামকে (৩২) টিএন্ডটি রোডস্থ পৌরসভার কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং মোল্লাপুর ইউনিয়নের কটুখালিপাড় এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে নিহত তারেক আহমদের (২৪) মরদেহ দাফন করা হয়েছে। নিহত সবারই ময়নাতদন্ত ছাড়াও দাফনকার্য সম্পাদন করা হয়।

অপর মামলার বাদী ও আহত নাজমুল ইসলাম চৌধুরী এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি বলেও অভিযোগে উল্লেখ করেন।

৫ আগস্টের ঘটনায় বিয়ানীবাজার থানায় ৪টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হত্যা ও একটি বিস্ফোরক দ্রব্যের মামলা। এসব মামলায় প্রায় দেড় শতাধিক আসামির নাম এজাহারে। আসামির তালিকায় আছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন খান, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব এবং বিয়ানীবাজারের ৫ জন সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।

পুলিশ বলছে, ‘অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ আশরাফ উজ্জামান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ৪টি মামলা হয়েছে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তারাই চার্জশিটে আসামি হবেন। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। প্রশাসন তাদের পাশে আছে।’