৫ আগস্ট, ২০২৪ : একটি ভিড়, একটি গণ-অভ্যুত্থান
একজন খুনির হাতের যদি আপনি পাঠখড়িও দেন তবু সে ওটা দিয়েও মানুষ খুন করতে উদ্যত হবে। মূলত খুনিরা হয় উন্মাদ। তাদের কাছে মারণাস্ত্র আর গোলাপ একই বস্তু। খুনই তাদের ধর্ম। রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই তারা নতুন খুনের সন্ধানে নামে। বিগত সরকারপ্রধান ছিলেন মূলত একজন খুনি ও ফ্যাসিস্ট। খুনই ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। শুধু যে তিনি খুন করেই ক্ষ্যান্ত হতেন তা নয়। তার ছিল ভিন্ন ভিন্ন কূটকৌশল। হাটে-বাজারে-অফিসে-মহল্লায় এমনকি মানুষের বেডরুম পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন তিনি। মানুষ তার নিজ পরিচয় ভুলে পরিধান করেছিল স্বৈরতন্ত্রের পোশাক, যে পোশাকগুলোর নাম ছিল কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও যুবলীগ, আবার কখনও ছাত্রলীগ। মা-বাবার দেওয়া নাম ভুলে মানুষ বলা শুরু করেছিল, আমাকে চেনেন না? আমি ছাত্রলীগ করি!
এসব না বলে মানুষের উপায়ও ছিল না। কারণ বাংলাদেশের মানুষের কাঁধে তখন ভয়াবহ এক দানব ভর করে বসে ছিল। একটু ভুল হলেই ঘাড় মটকে রক্ত পান। ফ্যাসিস্টের চরিত্রটাই এমন, আপনাকে সম্পূর্ণ গিলে ফেলবে এই সিস্টেম। আপনার নিজস্ব কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকবে না। বাকস্বাধীনতা চলে যাবে। আপনার জিহ্বা তিরতির করবে কিন্তু বলতে পারবেন না কিছুই। একটু পেছনের দিকে স্মরণ করে দেখুন, বিগত স্বৈরাচার শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে শুধু যে সরাসরি খুন, কিংবা গুম করে দিয়েছিল তা নয়, মনস্তত্ত্বভাবে আপনাকে করে ফেলেছিল পঙ্গু। পত্রিকার পাতায় কলম দিয়ে, টিভির টকশোতে জিহ্বা দিয়ে আর মহল্লার মোড়ে মোড়ে মাইক বসিয়ে পচিয়ে ফেলেছিল আপনার শ্রবণ ইন্দ্রিয়।
আরও পড়ুন:
আমাকে সাত বছর বোবা করে রাখা হয়েছে: কনকচাঁপা
এসবে অতিষ্ঠ হয়ে একটা সময় মানুষ বলা শুরু করল- তুই মানুষ, না আওয়ামী লীগ? মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষ সত্যিই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গিয়েছিল। পশুপাখি, গাছপালা, নদীনালা বাদে সবাই যেন আটকে পড়েছিল এক ভয়ংকর ট্রমায়। এই ট্রমা থেকে বের হতে মানুষ বহুদিন থেকে ভেতরে ভেতরে শান দিচ্ছিল। তাই ৫ আগস্ট, ২০২৪-কে কোনোভাবেই এক দিনের ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। এটি দীর্ঘদিনের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ও বৈষম্যের স্বীকার হওয়া মানুষের গল্প। ৫ আগস্ট, ২০২৪ ছিল এমন একটি ভিড়, যে ভিড় একটি গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে। এই আন্দোলনকে বুঝতে ফরাসি চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক গুস্তাফ লে বঁ (১৮৪১-১৯৩১)-এর লেখা The Crowd : A Study of the Popular Mind (1895) বইটি উল্লেখযোগ্য। ভিড়ের মনোবিজ্ঞানীর (Crowd Psychology) জনক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। তিনিই প্রথম বুঝিয়েছিলেন যে ভিড় শুধু একটি সংখ্যা নয়, বরং একটি শক্তিশালী মানসিক সত্তা- যা ইতিহাস বদলে দিতে পারে। তিনি বলতেন, ‘একজন মানুষ যখন ভিড়ের অংশ হয়ে যায় তখন সে এমন কাজ করতে পারে যা সে একা কখনোই করতে পারত না।’
আরও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় ও চ্যালেঞ্জ
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের দিনে ‘আমি’র চেয়ে ‘আমরা’ হয়ে উঠেছিল মুখ্য। Social Identity Theory অনুযায়ী এই ‘আমরা’ বোধই হলো আন্দোলনের চালিকাশক্তি। দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ফলে বাংলাদেশের মানুষ সম্মিলিত পরিচিতি গড়তে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। তাই তারা দলগতভাবে ওই দিন ফুঁসে ওঠে। নদীর স্রোতের মতো দলে দলে বেরিয়ে পড়ে নতুন এক বাংলাদেশের মুখ দেখতে। বহুদিনের অত্যাচারের জবাবে এক আবেগীয় বিস্ফোরণ ঘটে সেদিন। মানুষ তার আত্মমর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তা ও ন্যায্য ভবিষ্যতের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল দলে দলে। কে নামেনি ওই দিন পথে? শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রিকশাওয়ালা, দোকানি, শ্রমজীবী, গার্মেন্টসকর্মী থেকে শুরু করে প্রতিটি সাধারণ জনগণ। মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষোভ রূপান্তিত হয়েছিল সামষ্টিক ক্ষোভে। এটি শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, বরং মানুষের সম্মিলিত যন্ত্রণার অভিব্যক্তি। বাংলাদেশের মানুষ সেই যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিল বহুদিন ধরে। গণমানুষের এই সম্মিলিত শক্তির সামনে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট যন্ত্র নতজানু হতে বাধ্য হয় অবশেষে। গণজোয়ারে পিষ্ট হয় দানব সরকারের সব ইমারত। এই অভ্যুত্থান কোনো রাজনীতির খেলা নয়, এটি মানুষের চেতনা, ক্ষোভ ও আশাভঙ্গের মানসিক প্রতিক্রিয়া। দার্শনিক গুস্তাফের ভিড়ের মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা বলতে পারি, মানুষ যখন একা থাকে তখন সে চুপ থাকে। কিন্তু যখন সে দেখে তার মতো আরেকজনও অসন্তুষ্ট তখনই ‘আমরা’র চেতনা জেগে ওঠে, যার ফলে জন্ম হয় নতুন ইতিহাসের। া