ভিনদেশি পাতায় আমাদের জুলাই
বর্ষা যেমন সবাইকে ভিজিয়ে যায়, বিপ্লবও তেমনি সমাজের সব স্তরের মানুষকে যুক্ত করে- নিয়ে যায় বৃহত্তর মুক্তির প্রান্তরে। গত বছর জুলাই আন্দোলনে দেশের আপামর জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই ১৬ বছরের জগদ্দল পাথরকে আমরা সরাতে পেরেছিলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলন কয়েক দিনের মধ্যেই পরিণত হয়েছিল ‘লাল জুলাইয়ে’। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে ডেকেছিলেন ‘মুনসুন রেভল্যুশন’ বলে।
১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। ওই দিন দেশজুড়ে নিহত হয় আরও ৫ জন। আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী। এতে দাবানলের মতো ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই দিনই যেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম চোখ তুলে তাকায় বাংলাদেশের দিকে। প্রায় সব মিডিয়াই গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির বিষয়টি তুলে ধরে বিশ্বদরবারে। এ নিয়ে আল-জাজিরা, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, আনাদলু এজেন্সি, এএফপি, ওয়াশিংটন পোস্ট, এপির মতো প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
১৬ জুলাই শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে ছাত্ররা ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি দেয়। কর্মসূচিতে পুলিশ ব্যাপক মারমুখী আচরণ করে; সঙ্গে যোগ হয় ছাত্রলীগের তাণ্ডব। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৮ জুলাই গভীর রাতে সরকার কারফিউ জারি করে এবং সেনা মোতায়েন করে। এই দিন আন্তর্জাতিক প্রায় সব মিডিয়াই খবরটি গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করে। আরব নিউজের শিরোনাম ছিল ‘মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ, বাংলাদেশের রাজপথে সেনা’। ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, ‘বাংলাদেশে কারফিউ জারি, বেশ কয়েকজন নিহত’।
আন্দোলনের একপর্যায়ে সংবাদকর্মীরা টার্গেটে পরিণত হন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ১৯ জুলাই উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদনে জানায়, একজন সাংবাদিক নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছেন। একই দিন ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হাসিনা সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ’। ১৯ জুলাই লন্ডনের এসওএস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রফিক হোসাইন জুলাই আন্দোলনকে দেখেছিলেন আরও বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি নিবন্ধে লেখেন, ‘কোটা সংস্কারের চেয়ে অনেক বড় বাংলাদেশে চব্বিশের গণজোয়ার’। ওই লেখায় তিনি শহীদ আবু সাঈদের মায়ের আর্তনাদ তুলে ধরেন। আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’
বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক সহিংসতা পর্যবেক্ষণ ও তথ্যসংগ্রহকারী মার্কিন ভিত্তিক সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা (এসিএলইডি) ২৬ জুলাই জানিয়েছে, ২০১৮ সালের তুলনায় এবারের বিক্ষোভ অনেক বিস্তৃত ও অনেক বেশি সহিংস। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করে, কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে।
এই সময়টাতে অর্থাৎ জুলাইয়ের ২৪, ২৫, ২৬ তারিখের দিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। এসব লেখায় হাসিনা টিকতে পারবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এত নৈরাজ্যের পরও ভারত যে ‘চুপ থাকার’ নীতি গ্রহণ করেছিল ৩০ জুলাই তা জানিয়েছে ডয়েচে ভেলে।
১ আগস্ট বিশ্লেষণধর্মী সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশন জানায়, বাংলাদেশে আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনী বর্বরতা চালিয়েছে- এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। আগস্টের দুই তারিখ ইউনিসেফ সতর্ক করে, ‘জুলাই আন্দোলনে ৩২ শিশু নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকে, শিশুদের আটকও করা হয়েছে। রক্তাক্ত আন্দোলনের প্রায় চূড়ান্ত পর্বে যোগ দেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। ২০২৪ সালের ২ আগস্ট নিক্কেই এশিয়া এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিরা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তারা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করেছেন।
এরপর সেই জনতার বিজয়ের দিন! ৫ আগস্ট, ২০২৪। গোটা বিশ্বের চোখ সেদিন বাংলাদেশের দিকে। কী হয়, কী হয়... পর্বতসম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অবশেষে খবর এলো হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। া