গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের পথচলা

সাইফুল হক
০৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের পথচলা

৫ আগস্ট ২০২৫ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, এর পরিণতি নির্ভর করছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রজ্ঞা, কার্যকারিতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। ২০২৪-এ ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান ছিল একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রতিরোধের গণজাগরণ। জনগণের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ, বিস্তৃতি, লড়াইয়ের মেজাজ, দেশের ডাকে জীবন উৎসর্গ করার প্রতিযোগিতা এবং যেকোনো মূল্যে বর্বর ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন হটাতে অপ্রতিরোধ্য সাহস আর বিজয় যেন ধ্রপদী আখ্যানের মতো। এই গণ-অভ্যুত্থানে বিপ্লবী পরিবর্তনের নানা উপাদান ছিল, ছিল বিপ্লবী পরিবর্তনের অদম্য এক আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু তা বিপ্লব ছিল না। স্বতঃস্ফূর্ত এই গণ-অভ্যুত্থানে বিপ্লবী প্রবণতা ছিল সত্য, কিন্তু তার পেছনে ছিল না বিপ্লবী নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শ- বিপ্লবী রাজনীতি, বিপ্লবী সাংগঠনিক নেতৃত্ব। ছাত্র-তরুণরা গণ-অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনে থাকলেও আন্দোলনে ছিল ছোট-বড় নানা কেন্দ্র। এর মধ্যে একটা অনানুষ্ঠানিক সমন্বয়ের চেষ্টা ছিল।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানকারীদের কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সে উদ্যোগও ছিল না। গণ-অভ্যুত্থানকারী ছাত্র, তরুণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে এমন এক অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো, যে সরকারের অধিকাংশের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না। বস্তুত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা এক দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক মাফিয়াদের কাছ থেকে একই শাসকশ্রেণির মধ্যকার কিছু উদারনৈতিক ব্যক্তির কাছে গেল। এরা অধিকাংশই গণ-অভ্যুত্থানের পরিবর্তনকামী জন-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেননি। অথচ দীর্ঘ পনেরো বছরের এক ঘনঘোর অমানিশার অবসানের পর বিপুল স্বপ্ন আর আশা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল, গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় যার অনেকখানি মরীচিকার আক্ষেপ আর হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। বৈষম্যের বিলোপে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। গেল এক বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, কর্মহীনতা, বিনিয়োগে ভাটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে, কিন্তু অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নের গোটা ব্যবস্থা প্রায় অক্ষুণ্ন রয়েছে। অর্থনৈতিক মাফিয়াদের সঙ্গে সরকার ও তাদের প্রশ্রয়ে থাকা নানা অংশের এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। এ-ও বুঝি নতুন এক ধরনের বন্দোবস্ত!

এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক দল ও জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা সরকার প্রজ্ঞার অভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে অহেতুক প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ফেলেছে। বিএনপিসহ অন্যদের রাজনৈতিক দাবি রাজনৈতিকভাবে সুরাহা না করে তারা নিজেদের ক্ষমতা খানিকটা নিষ্কণ্টক রাখতে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শক্তিকে নানাভাবে মদদ জুগিয়ে আসছে। দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থানের পেছনে অতীত সরকারগুলোর নিছক ক্ষমতাকেন্দ্রিক নীতিহীন রাজনীতির পাশাপাশি পরোক্ষভাবে বর্তমান সরকারেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক ভারসাম্যে এই পরিবর্তন দেশের জন্য বহুমুখী ঝুঁঁকি সৃষ্টি করেছে। এর সমগ্র অভিঘাত দেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁঁকি নিয়ে আসছে।

রাজনৈতিক দল ও জনগণের ওপর নির্ভর না করে নানা গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল ইস্যুতে সরকারের ভেতরে থাকা সরকার মব সন্ত্রাসের ওপর নির্ভর করতে চেয়েছে। এর ফল হয়েছে এক আধা-নৈরাজ্য। এই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করছে রাজনৈতিক লুম্পেন ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তরা। এ কারণে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা আরও বিপদের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ক্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারের কার্যকারিতা বলে তেমন কিছু থাকছে না। দেশের মানুষ এখন সরকারকে কীভাবে দেখছে সে ব্যাপারে সরকারের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। আর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেশের বহুমাত্রিক নিরাপত্তা ঝুঁঁকিও বৃদ্ধি করে চলেছে। এতসব নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ রয়েছে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের পর গত বছর গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। মানুষ দেখতে চায়, বিচারের এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার ও গতিশীল হবে। দ্বিতীয়ত, সংবিধানসহ সমগ্র শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্যোগে ইতোমধ্যে যথেষ্ট অগ্রগতির লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ২৩ দিনের বৈঠকে ২০টি বিষয়ের মধ্যে ১৯টিতেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে ‘জুলাই সমঝোতা সনদ’ স্বাক্ষরিত হবে। রাজনৈতিক দিক থেকে এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এই সনদ কার্যকরী করা গেলে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য এনে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ খানিকটা প্রশস্ত হতে পারে।

এই সনদ স্বাক্ষরের পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ম্যান্ডেট হচ্ছে, তাদের ঘোষণা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার অবসান ঘটলে বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিরও খানিকটা অবসান হবে বলে আশা করা যায়। তবে অবাধ নির্বাচনের পথেও সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নসহ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের পরিষ্কার রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে বিচার ও সংস্কারের প্রক্রিয়ায় জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পরবর্তী মাইলফলক অতিক্রম করা কঠিন হবে না।

তবে গেল জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা কীভাবে ধারণ করবে, এগিয়ে নেবে, আসলে তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। া