জুলাই অভ্যুত্থানের রসায়ন
পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান। এমন একটি অভ্যুত্থান কীভাবে সম্ভব হলো, এর একরৈখিক তত্ত্ব হাজির করা অসম্ভব। এটা অনেকটা বৃষ্টির মতো। বিজ্ঞান সহজ অর্থে আমাদের জানায় মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। তবে মেঘ মানেই বৃষ্টি নয়। আরও অনেক শর্ত এতে যুক্ত থাকে। যেমন- তাপমাত্রা, ধূলিকণা, বাতাস, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে সব শর্ত পূরণ হলে বৃষ্টি নামে। আবার কী পরিমাণ বৃষ্টি হবে, তা-ও কোনো পূর্বনির্ধারিত তত্ত্ব বা তথ্য দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে এই বৃষ্টি নামার একটা মিল আছে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন অত্যাচার-নিপীড়ন-দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের আকাশে অনেক মেঘ জমা হয়েছিল। একটা উপলক্ষ দরকার ছিল সব মেঘ একীভূত করার। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা আন্দোলন ছিল সেই উপলক্ষ।
তাত্ত্বিক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘এ অঞ্চলে মোট পাঁচটি অভ্যুত্থান হয়েছে। শুরুর অভ্যুত্থানটি ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশেই গণ-অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ অঞ্চলে ১৯৫২ সালে আমরা প্রথম গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম ১৯৬৯ সালে। তৃতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে। নব্বইয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে চতুর্থ গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। এই প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫২ সালের ক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন সরাসরি হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানের শুরুর দিকের এ সময়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো গঠিত হয়। দেখা যায়, বায়ান্নর আন্দোলনের পরিণতিতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকার পতন হয়। শুধু যে সরকারের পতন হয়েছিল তা-ই নয়; মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তাতে সামরিক সরকার টিকে থাকলেও আইয়ুব খানের সরকার উচ্ছেদ হয়ে ইয়াহিয়া খানের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৭১ সালে জানুয়ারি কিংবা এর আগেই ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ফলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, সরকার তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আর সক্ষম ছিল না। তখন প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা করতে বাধ্য হয়েছিল।’
যার ফলে ২৫ মার্চ আসে। ১৯৭১ সালের এ দিনে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে।
আরও পড়ুন:
দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই চ্যালেঞ্জ বিএনপির
২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান এ ভূখণ্ডে হয়ে যাওয়া অন্য চার অভ্যুত্থান থেকে আলাদা নানা কারণে। এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন এমনভাবে ঘটেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে যান, সব সংসদ সদস্যসহ প্রশাসন-পুলিশের কর্মকর্তারাও পলাতক থাকতে বাধ্য হন। এমনকি বায়তুল মোকাররমের খতিবকেও পালিয়ে যেতে হয়েছে। আর এ অভ্যুত্থান চলাকালে সরকারি বাহিনী যে নৃশংসতা, গণহত্যা চালিয়েছে, তা এশিয়ার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে পৃথিবীর আর কোথাও এমনভাবে সরাসরি মানুষ হত্যা করা হয়েছে কিনা, খোঁজ নিতে হবে। আমার জানাশোনায় মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীরা বর্তমান শাসক আল ফাত্তাহ সিসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গেলে মৃতের সংখ্যা ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এ ছাড়া সিরিয়ায় বাসার আল আসাদও এত আন্দোলনকারীকে বিক্ষোভ চলাকালে হত্যা করেনি। বিক্ষোভ চলাকালে প্রকাশ্য রাস্তায়, স্থল ও আকাশপথে হামলা চালিয়ে এত অল্প সময়ে এত মানুষ হত্যার প্রশ্নে শেখ হাসিনা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয়। তবে এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ফলে শুরুতে যে কথাটি বলেছিলাম, জুলাই অভ্যুত্থান পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য, সেটা অল্পে বোঝানোর চেষ্টা করলাম এখানে। এখন একটু এর রসায়নের দিকটা দেখব। জুলাই অভ্যুত্থানের শুরুটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেখানকার ছাত্ররা আদালত কর্তৃক সরকারি চাকরিতে কোটা ফিরিয়ে আনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। এর আগে ২০১৮ সালেও কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। সেই ইতিহাসে যাব না। ২৪-এর আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন আগের আন্দোলনের অনেক শিক্ষা কাজে লাগানো হয়। যেমন এমন কিছু শিক্ষার্থীকে সামনে নিয়ে আসা হয়, যারা ছিলেন খুব কম পরিচিত। আর আন্দোলনকারীরা গোটা আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেখেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই মারধর, গ্রেপ্তার বা গুম করা হয়। সে জন্য তারা এমনভাবে পরিকল্পনা সাজান যে একক কোনো নেতৃত্ব নয়, বরং অনেক নেতা নিয়ে আন্দোলন করা হবে। ২০২৩ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করে, যা তারা প্রচারও করে। একইভাবে পালিয়ে থাকা, আড়িপাতা যন্ত্রের হাত থেকে রেহাই পেতে বাটন ফোন ব্যবহার, সিম পরিবর্তন; আজ এখানে তো কাল ওখানে ইত্যাদি সমস্ত কৌশলই আসলে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন মোকাবিলা করতে গিয়ে বিএনপি, জামায়াত, রাষ্ট্রচিন্তা, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরাসহ বিরোধীরা অবলম্বন করেছিল। সেখান থেকে কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা শিখেছেন।
আরও পড়ুন:
দেশের রাজনীতিতে বইছে মুক্ত বাতাস
এর ফলে কী হয়েছে? জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বৃষ্টির মতোই একটি ঐশী বা গায়েবি সক্ষমতা অর্জন করেছে। যেটা আমরা আট দফা না নয় দফা- এই বিতর্ক খেয়াল করলে বুঝতে পারব। যেমন- আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা সম্মিলিতভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নেন। পরে শিক্ষার্থী নেতারা কেউ গুম হন বা কেউ গ্রেপ্তার হন। কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তগুলোকে তো আর গুম বা গ্রেপ্তার করা যায়নি। সেগুলো জিন্দাই ছিল। যাদের ওপর ভর করে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তারা গুম, গ্রেপ্তার বা পালিয়ে যাওয়ার ফলে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা বাড়ে। যাদের লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগকে ফেলে দেওয়া। নয় দফা থেকে শুরু করে আন্দোলন পরিচালনায় তাদের প্রভাব বাড়ে। যদি এমন হতো যে, সরকার ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার বা গুম করছে না, তারা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন; তাহলে কী ঘটত, বলা যায় না।
এর বাইরেও ১৬ জুলাই আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরামসহ ছয়জন নিহত হলে এ আন্দোলন আর কোটায় সীমিত থাকার সুযোগ ছিল না। এ আন্দোলন তখন মানুষের অন্তর কাঁপিয়ে দেয়। পাগলপারা মানুষ বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর গুলির মুখে বুক পেতে দিতে আর দ্বিধা করে না। কোথায় কী ঘটছে, কী হচ্ছে; তার কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। খালি চোখে মনে হতে পারে, শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি দিচ্ছেন আর মানুষ সেটা পালন করছে। তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো বিষয়টা ছিল অন্য। মানুষের আত্মাহুতি, ক্ষোভ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, শিক্ষার্থী নেতাদের পক্ষে জনগণের আকাক্সিক্ষত কর্মসূচির বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। জনগণ পাগলা ঘোড়ার মতো তাদের গাড়িটাকে টেনে এক মহাকল্লোলের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছে। যার ফলাফল হিসেবে শেখ হাসিনা পালিয়েছে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কবল থেকে মানুষ মুক্ত হয়েছে।
জুলাইজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষ আবার স্বাধীন করেছে নিজেদের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও ঘটেছে এ রসায়নে। একক নেতৃত্ব, একক দল, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। অনেকটা বৃষ্টির মতো। দুনিয়াতে সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। একইভাবে বলা চলে, সবচেয়ে সুন্দর গণ-অভ্যুত্থানও হয় বাংলাদেশে। যাকে এক কথায় বলতে হয়- মনোমুগ্ধকর। া