দ্রুত জাতীয় নির্বাচনই চ্যালেঞ্জ বিএনপির
১৭ বছর পর মুক্ত পরিবেশে ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ
ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির ১৭ বছরের দুঃসহ রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। মামলা-হামলা ও নির্যাতনে পর্যুদস্ত দলটি এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় ১৭ বছর পর মুক্ত পরিবেশে বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন হচ্ছে আজ। যদিও বন্যার কারণে ৫ দিনের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে একদিন করা হয়েছে। এদিকে পরিবর্তিত এ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনকেই চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিমতই পাওয়া গেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে নাগাদ হবে- এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ নিয়ে বিএনপির ভেতরে খানিকটা অস্থিরতাও রয়েছে। দলটি চায় দ্রুত সময়ে যেন জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ শুরু করবে দলটি। ইতোমধ্যে এ ইস্যুতে কথা বলতেও শুরু করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আমাদের সময়কে বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আদায় করাই এখন বিএনপির প্রধান লক্ষ্য।
বিএনপির কর্ম-কৌশল প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় এক নেতা আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপির একটি দুঃসহ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন কবে হবে, সেই সংশয় রয়ে গেছে। ফলে বিএনপিকে চূড়ান্ত সফলতার জন্য আরেকটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। সেই কাজটি করতে গেলে নানা বাধা আসবে। এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কীভাবে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায় করা হবে- এ লক্ষ্যে দলের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, সংগঠন গোছানো, রাজনৈতিক মিত্রদের পাশে রাখা এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করাটাও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বিএনপির বিরুদ্ধে এক ধরনের অপপ্রচার চলছে বলেও মনে করেন তারা। এ অপপ্রচার মোকাবিলা করতেও তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে বিএনপি ইতোমধ্যে বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে বিএনপি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে নির্বাচন ও বর্তমান করণীয় সম্পর্কে দলের বার্তা তুলে ধরা হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ডান-বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে গত সাড়ে ১৫ বছর রাজপথে আন্দোলন করেছেন তারা। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটলে নতুন প্রেক্ষাপটে আন্দোলনরত দলগুলোর চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। বিএনপির অন্যতম প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে সম্পর্কেও এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। ফলে মিত্রদের সঙ্গে ঐক্য অটুট রাখাও বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর মূল দায়িত্ব নিতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে আমাদের পরিকল্পনা আছে। ইতোপূর্বে ঘোষিত ৩১ দফায় রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছিল।
দলের একাধিক নেতা বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে ধারণ করেই তারা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। থাকবে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার গঠন, গণতান্ত্রিক পন্থায় বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলটিকে দেশি-বিদেশি নানা মহলের বাধার মুখেও পড়তে হতে পারে। এ সব বাধা অতিক্রম করাও তাদের মূল চ্যালেঞ্জ।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ১৯৭৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া বিএনপির ৪৬ বছরে ইতিহাসে এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং এ কৃতিত্ব তারা নিতে পারেন। এখন তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে, নেতৃত্ব বাছাই থেকে শুরু করে দলটির সর্বত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা, স্বচ্ছভাবে অর্থ সংগ্রহ করা। এটা করতে পারলে দেশ-বিদেশে সবার কাছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করার যোগ্য দল হিসেবে তারা প্রমাণিত হবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে বিএনপি যে ৩১ দফা ঘোষণা দিয়েছিল, তা ভুলে গেলে হবে না। কারণ, এটা ভুলে গেলে মানুষের মাঝে ধারণা সৃষ্টি হবে যে, বিএনপির প্রস্তাবগুলো ছিল কথার কথা। এ মুহূর্তে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবগুলো সামনে এনে আলোচনা করারও পরামর্শ দেন এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের অবসানের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছি। এখন বিএনপির অনেক দায়িত্ব। বিশেষ করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরাতে প্রথমেই মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেওয়া, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে।
নেতাকর্মীরা উদ্দীপ্ত
বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, তাদের এখন আর একের পর এক মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হওয়া কিংবা রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে নির্যাতিত হওয়ার ভয় নেই। তারা মিথ্যা মামলাগুলো থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কারাগার থেকে বের হয়ে আসছেন। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও স্থায়ী মুক্তি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রক্রিয়াও চলছে। সব মিলিয়ে সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন আমাদের সময়কে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদের পতনের পর নতুন প্রেক্ষাপটে মুক্ত পরিবেশে আমরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেছি। ফ্যাসিবাদের পতনের এ দৃশ্য পৃথিবীর সকল ফ্যাসিবাদী শাসকের জন্য একটি আতঙ্কজনক দৃষ্টান্ত। এখানে প্রমাণিত হয়েছে, ছাত্র-জনতার শক্তিই হচ্ছে চূড়ান্ত শক্তি। এ প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী একদিকে বিজয় উদযাপনের, অপরদিকে দেশে ছাত্র-জনতার রাজনীতি ও সরকারের কাছে উত্থিত নতুন প্রত্যাশা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি
দেশে চলমান বন্যার কারণে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। ৫ দিনের কর্মসূচি কমিয়ে একদিন করা হয়েছে এবং শীর্ষপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছেÑ এ অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য ব্যয়ের অর্থ বন্যাদুর্গতদের জন্য ব্যয় করা হবে। আজ রবিবার সকাল ৬টায় ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বেলা ১১টায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। বাদ জোহর দলীয় কার্যালয়ের সামনে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা