সিস্টেম লসের অজুহাত গ্যাস চুরি থামছে না
সরকারি হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। অথচ চাহিদার তুলনায় মাত্র অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে সরকার। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই পূরণ করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। ফলে দেশের শিল্প কারখানাগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তবে যতই সংকট থাকুক, মূল্যবান গ্যাসের চুরি থামছে না। হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাস চুরি হলেও সরকারি নথিপত্রে দেখানো হয় সিস্টেম লস হিসেবে। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুন ব্যতীত) সোয়া ৩ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি নথিতে যাই থাকুক, প্রকৃতপক্ষে এটা চুরি।
বিশ^ব্যাপী গ্যাস সরবরাহে ২ শতাংশ সিস্টেম লসকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গ্যাসের সিস্টেম লস কোম্পানি ভেদে এখনও প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে গ্যাসের অপচয় বা সিস্টেম লস হয়েছে গড়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ গ্যাস অপচয় হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতি ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে সঞ্চালন লাইনে অপচয় হয়েছে আরও ২ শতাংশ।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, সিস্টেম লস সর্বোচ্চ ২ শতাংশে থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে অতিরিক্ত হচ্ছে। এটা মূলত অপচয় বা গ্যাস চুরি। তিনি বলেন, গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অনেক বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কোনোভাবেই ২ শতাংশ হওয়ার কথা নয়। এগুলো ভালোভাবে দেখা উচিত। তা না হলে যে কোনো সময় দেশে জ¦ালানি নিরাপত্তা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যাবে।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, দেশে গ্যাস সংকট রয়েছে। সেগুলো কমিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গভীরভাবে দেখা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে। আমরা রেজাল্ট পাচ্ছি।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
উল্লেখ্য, দেশে গ্যাসের যে চাহিদা, তাতে কমপক্ষে প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে। গ্যাসের চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায়ও বিভিন্ন খাতে গ্যাসের চুরি, অপব্যবহার, বাইপাস গ্যাস সংযোগ, পাইপলাইনের লিকেজ বন্ধ করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে গ্যাসের অপব্যবহার। তবে সব ধরনের গ্যাসের অপব্যবহার ও চুরিকে সিস্টেম লস বলে চালিয়ে দিচ্ছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব চুরির দায়ভার সাধারণ গ্রাহকের কাঁধেই পড়ছে কোনো না কোনোভাবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, এক সময় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো উৎস থেকে জিটিসিএল পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করত। মাস শেষে বিভিন্ন কোম্পানির সিস্টেলম লস নির্ধারণ করা হতো অনেকটা অনুমাননির্ভর। তাতে সবচেয়ে
বেশি সিস্টেল লস তিতাস গ্যাস কোম্পানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। তবে তিতাস গড়পড়তা সিস্টেম লস চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ করে গ্যাসের প্রবেশপথে মিটারিংয়ের দাবি জানিয়ে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দেয়। পরে পেট্রোবাংলা কয়েক বছর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জিটিসিএল থেকে শুরু করে সবগুলো গ্যাস বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের ইন-পয়েন্টে মিটার স্থাপন করে। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে মিটার স্থাপন করেছে। এসব মিটারের মাধ্যমে সিস্টেম লস বা গ্যাসের চুরি নির্ধারণ করা হয়।
পেট্রোবাংলা বলছে, মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো পর্যায়ে গ্যাস সিস্টেম লস কতটুকু এবং তার আর্থিক মূল্য কত, তা সম্পূর্ণ হিসাব করা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
পেট্রোবাংলা সিস্টেম লসের কারণ এবং সেটা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখছে। এর মধ্যে দুটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কোম্পানি দুটি হলো বারখরাবাদ ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি। এ দুটি কোম্পানির পাইপলাইন অনেক বছরের পুরনো। এ দুটি কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ সংযোগ, বাইপাস, পাইপলাইনের লিকেজ, কারখানায় গ্যাস চুরি ঘটনা রয়েছে। পেট্রোবাংলা বলছে, দুটির বিতরণ এলাকায় বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নানামুখী কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাইপলপাইন। ছিদ্র হয়ে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতি গ্যাস। এ ছাড়া গ্যাস খাতে বিভিন্ন স্থাপনায় যে ধরনের ফিটিংস ব্যবহৃত হয়, সেগুলোতেও অনেক লিকেজ তৈরি করেছে।
পেট্রোবাংলা বলছে, ২০১২ সাল থেকে মূলত সব ধরনের আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে আবাসিক খাতে গ্যাসে অবৈধ ব্যবহার এত বেড়েছে যে, গত এক যুগেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বিশেষ করে একই ভবনে চুলা এক্সটেনশন বা বর্ধিত হয়েছে লাখ লাখ। এগুলো বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তথ্য মতে, ২০২৩ সালে যেখানে জানুয়ারিতে গড় সিস্টেম লস ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, সেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস হওয়া কোম্পানির মধ্যে আছে তিতাস গ্যাস এবং বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তিতাসের সিস্টেম লস প্রায় ১১ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। বাখরাবাদের ২০২৪ ডিসেম্বরে সিস্টেম লস হয়েছে ১১ শতাংশ।
সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে পর্যন্ত জিটিসিএলের সিস্টেম লস ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, তিতাসের ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানি প্রায় ১ শতাংশ।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দেশে গ্যাস সরবরাহ এবং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং ব্যবস্থা পুরোপুরি ম্যানুয়ালি করা হয়। একটা বিতরণ অঞ্চলে যত শিল্প কারখানা আছে, সেখানে কেউ অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার করছে কি না, অথবা কোনো বাইপাস গ্যাস সংযোগ আছে কি না, অথবা মিটার টেম্পারিং আছে কি না, সেগুলো মূলত ওই জোনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা বা সততার ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, হরহামেশা গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়। ফলে গ্যাসের অপব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা অনেক কঠিন কাজ। এই কর্মকর্তা বলেন, অবশ্যই পুরো বিষযয়টিকে তথ্যপ্রযুুক্তি নির্ভর করতে হবে, যাতে কোথাও কোনো অনিয়ম হলেই কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা যায়।