মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক স্থিতিশীলতায় জোর
মূল্যস্ফীতি আরও কমানোর লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) জন্য আগের মতো কঠোর মুদ্রানীতির ধারা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলে আগামী ছয় মাস ব্যাংক ঋণের সুদহার কমার কোনো আশা নেই। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে। অর্থাৎ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান সংস্কারের আওতায় ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে ছয়টি চ্যালেঞ্জ থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এতে মুদ্রানীতির বিভিন্ন কৌশল তুলে ধরেন নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদ, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তিন দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এতে মূল্যস্ফীতি যেমন কমে এসেছে, তেমনি বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতিশীলতা। আবার ডলার সংকট কেটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ফিরেছে স্বস্তি। তবে মূল্যস্ফীতি এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রার ওপর থাকায় নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন না আনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মুদ্রানীতির বিবৃতিতে বলা হয়- বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে আগের মতো কঠোর আর্থিক নীতি বজায় থাকবে। আগামী জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য ১০ শতাংশ নীতি সুদহার বহাল থাকবে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের মৌলিক দায়িত্ব হবে দুটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা- এই দুটি দায়িত্বই আমরা প্রাথমিকভাবে পালন করতে চাই। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ধীরে-ধীরে কমছে। তবে এখনও আমাদের কাক্সিক্ষত মাত্রায় আসেনি। আমাদের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। মূল্যস্ফীতি কমে গত জুনে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা এবং উৎপাদন ভালো হওয়ায় এটা কমছে। চাল ছাড়া সব পণ্যের দর স্থিতিশীল রয়েছে।
গভর্নর বলেন, আমাদের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এরই মধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য সুশাসনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ভালো অবস্থানে ফিরিয়ে আনা। আমরা ব্যাংক রেজুলেশন নামে নতুন একটি বিভাগ করেছি। এর মাধ্যমে এই বার্তা দিয়েছি, আমরা সারাক্ষণ সব ব্যাংকের ওপর নজর রাখব। যদি কোনো ব্যাংক ভেঙে পড়ে, তাহলে আমরা সাথে সাথে সেটাকে অধিগ্রহণ করব। এটা ব্যাংক মালিকদের জন্য বিরাট সতর্কবার্তা।
বেসরকারি খাতে ঋণ কমবে: বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন আগামী ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২ এবং জুনে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ গত জুনে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। গত অর্থবছরে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনের বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বেসরকারি খাতে ঋণ কমানো নিয়ে গভর্নর বলেন, আগে যে ঋণগুলো বেনামে নেওয়া হয়েছে, পাচার করা হয়েছে, সেগুলো দেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত অর্থে কোনো অবদান রাখেনি। অথচ এই ঋণের কারণে তখন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হয়েছে। আর এখন যেই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটাই বেসরকারি ঋণের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি।
প্রবৃদ্ধিতে কোনো ভেজাল মেশানো নেই: প্রবৃদ্ধিতে নজর কম দেওয়া হলো কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, টাকা ছাপিয়ে, সরকারের ব্যয় বাড়িয়ে হয়তো বেশি প্রবৃদ্ধি দেখাতে পারব। কিন্তু এটা ধরে রাখা যাবে না। তাই যদি টেকসই প্রবৃদ্ধি চাই, তাহলে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আনতে হবে, যেখানে আমরা আছি। আমাদের পণ্যের দামের স্থিতিশীলতা স্বস্তিদায়ক করতে হবে। সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে। আগে ঘোষণা দিয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছিল। এটাও সঠিক পলিসি ছিল না। ফলে আমরা প্রবৃদ্ধিও পাইনি, মূল্যস্ফীতি কমাতে পারিনি। আমাদের যে প্রবৃদ্ধি, একেবারেই খারাপ হয়েছে, তা কিন্তু নয়। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে সন্তোষজনক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে আগামী অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হবে।
ব্যাংক মার্জার হলেও আমানতকারীদের ভয় নেই: গভর্নর বলেন, দুর্বল ব্যাংক মার্জার করা হলেও আমানতকারীদের অর্থ সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাদের পুরো অর্থই ফেরত পাবেন। ব্যাংকগুলোর বর্তমান যে চিত্র, মার্জার হলে আরও ভালো হবে। সরকার বড় অঙ্কের তহবিল জোগান দেবে। মুনাফাসহ সেই টাকা ফেরত নিতে পারবে সরকার। ফলে আমরা আশাবাদী, সফল মার্জারের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার ব্যাংক কেনার জন্য যায়নি। জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য গেছে। এসব ব্যাংকে এক বছরের সময় দেওয়া হয়েছিল। তারা উন্নতি করতে পারেনি। তাই এখন আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করছি। আমরা আরও ১৫-২০টি ব্যাংক একীভূত করার পরিকল্পনাও করেছি।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে ৫ চ্যালেঞ্জ: চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মুদ্রানীতিতে সামষ্টিক অর্থনীতি পাঁচ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। চ্যলেঞ্জগুলো হলো- ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি, আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, স্থবির বেসরকারি বিনিয়োগ ও উচ্চ খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়া। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রভাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।