সন্তোষজনক ঘোষণার অপেক্ষায় বাংলাদেশ
ট্রাম্প প্রশাসন আরোপিত পাল্টা-শুল্ক নিয়ে চূড়ান্ত দফার দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা শেষ করেছে বাংলাদেশ। আলোচনায় আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য প্রায় সম্পূর্ণ নিরসন হয়েছে। দেশটিতে সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা-শুল্ক কমার বিষয়টি শুধু নিশ্চিতই নয়, বরং এটি হবে সন্তোষজনক মাত্রায়। আলোচনায় যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেখানে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষ হয়েছিল দ্বিধায়, সেখানে এই তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপ দিচ্ছে এক পরিষ্কার সংকেত। আমাদের অবস্থান মূল্যায়ন পেয়েছে।’
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, পাল্টা শুল্ক হার ৩৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২০ শতাংশের আশপাশে নির্ধারণ করা হতে পারে। বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত ১১টায় এ সংক্রান্ত বৈঠক শুরু হয়। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা গত রাতে বলেন, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর ইউএসটিআরের সঙ্গে আমাদের একটি সফল আলোচনা হয়েছে। উভয় দেশই নিজেদের প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরেছে। দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার পর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খোঁজা হয়েছে। এতে করে ইউএসটিআর হয়তো বাংলাদেশের জন্য শুল্ক হার ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশের আশপাশে নামিয়ে আনতে পাারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো ঘোষণা আসেনি। এখন, সেই ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি না থাকা দেশগুলোর ওপর ব্যাপক হারে নতুন করে শুল্ক আরোপ করছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে রক্ষা করতে ওয়াশিংটন ডিসিতে শেষ সময়ের দর কষাকষি করছে বাংলাদেশ। আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তার সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা
উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত পাল্টা-শুল্ক হ্রাস, বাণিজ্য ভারসাম্য এবং পারস্পরিক আমদানি-বাণিজ্য সম্প্রসারণ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
এদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্য ২৫ শতাংশ শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের ওপর আরও কিছু জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ, ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ১৯ শতাংশ, জাপান ১৫ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ২০ শতাংশের আশপাশে হতে পারে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন দূতাবাসের একটি সূত্র।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম কারণ ভিয়েতনাম উদাহরণ। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে ১২৩ বিলিয়ন ডলার, সেখানে তারা ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কে সমঝোতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ঘাটতি মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগামী এক-দেড় বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যদিও দেশটি বলছে এক বছরের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের যে ঘাটতি, সেটা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেসরকারি খাত থেকেও তুলা, সয়াবিন, গম ও ডাল আমদানির লক্ষ্যে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে।
ট্রাম্পের এই শুল্কারোপ ইস্যু বর্তমানে যতটা না বাণিজ্যিক, তারচেয়ে বেশি অবাণিজ্যিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০২৪ সালে মার্কিন বাজারে রপ্তানিকৃত ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অধিকাংশই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বর্তমানে যে পরিমাণ শুল্ক রয়েছে, তারচেয়ে সামান্য বেশি শুল্ক ধার্য করা হলেও রপ্তানি প্রতিযোগিতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ধস নামবে শ্রমবাজারেও।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ভেস্তে গেছে মার্কিন-ভারত আলোচনা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনায় কিছু দেশ বাংলাদেশের চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্কের ধাক্কা খেয়েছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার কাছ থেকে সামরিক ও জ্বালানি পণ্য কেনায় ভারতের ওপর আরও শাস্তি আসতে যাচ্ছে বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকদের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলা আলোচনা ভেস্তে গেছে। কারণ মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য তাদের বাজার উন্মুক্ত করতে রাজি হয়নি দিল্লি। গম, চাল, ভুট্টাসহ বেশকিছু পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থ সুরক্ষার কারণ দেখিয়ে ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে দিল্লির রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ছিল ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এখন, বাংলাদেশ যদি এ চুক্তি কাক্সিক্ষত শুল্কে সম্পন্ন করতে পারে এবং অন্য দেশগুলোর তুলনায় শুল্ক কমাতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বাজার ধরায় এগিয়ে থাকবে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির কাক্সিক্ষত গতিপথ নির্ধারণেও সহায়ক ভূমিকা রাখবে।