মার্চ ফর জাস্টিসে পুলিশি বাধা, মাত্রা পায় বিএনপির অংশগ্রহণে
গত বছরের ৩১ জুলাই পূর্বঘোষিত মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচিতে ছাত্র-শিক্ষকদের পাশাপাশি দলীয় ব্যানার ছাড়া ব্যাপকভাবে অংশ নেন বিএনপি ও এর সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকারের হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে এবং আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের মুক্তি, গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তিসহ ৯ দফা দাবিতে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এই দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলীয় ব্যানার ছাড়া গ্রেপ্তার এড়িয়ে দলীয় নেতাকর্মী, যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে রাজপথে থেকে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে অংশ নেন। এই বৈঠকের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে দলীয় নেতাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন তারেক রহমান। এদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলনে গুলি চালানোর প্রমাণ থাকার পরও জড়িত কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার না করে অপরাধীকে খুঁজে বেড়ানো উপহাস মাত্র। অজ্ঞাত স্থান থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় মুঠোফোনে জানান, শেখ হাসিনার পতন ছাড়া বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরবে না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান নব্বইয়ের ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা।
৩১ জুলাই বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময়ে শেখ হাসিনা প্রণয় ভার্মাকে বলেন, ‘সহিংসতাকারীরা আসলে তার (শেখ হাসিনা) সরকারকে উৎখাতের জন্য শ্রীলঙ্কায় যেমনটি ঘটেছিল, ঠিক সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসসহ তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ৩১ জুলাই দুপুরে সচিবালয়ে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন। তারা জিজ্ঞাসা করেন, আর কত দিনের মধ্যে বাংলাদেশের এই অবস্থা স্বাভাবিক হবে।
এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এদিন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন স্থানে আহত হন শতাধিক মানুষ। সারাদেশে আটক করা হয় দুই শতাধিক বিক্ষোভকারীকে।
এদিন মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি উপলক্ষে দুপুর ১২টা থেকে হাইকোর্টের মাজার গেট এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের কয়েকজন শিক্ষক সেখানে যোগ দেন। হাইকোর্টের ভেতরে আইনজীবীদের একটি দলও মিছিল করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ দুপুর ১টার দিকে মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। একপর্যায়ে তারা দোয়েল চত্বরে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করে তারা।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও অংশ নেন। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করা হয়। সিলেটে একই কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে গিয়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
৩১ জুলাই মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি থেকে নতুন কর্মসূচি রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ (আমাদের নায়কদের স্মরণ) ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সব শ্রেণিপেশার মানুষকে ১ আগস্ট অনলাইন ও অফলাইনে এই কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানানো হয়। আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো বিবৃতিতে ১ আগস্ট শহীদ ও আহতদের নিয়ে স্মৃতিচারণ, চিত্রাঙ্কন, গ্রাফিতি, দেওয়াল লিখন, ডিজিটাল পোর্ট্রেট তৈরির আহ্বান জানানো হয়।
১৪ দিন পর এদিন বাংলাদেশে সচল হয় ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক মাধ্যম। পরিস্থিতি সহিংস হওয়ার মধ্যেই অনেক মন্ত্রী-এমপি দেশ ছাড়েন। শেখ হাসিনা দেশব্যাপী সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। এদিন পুলিশের আলোচিত অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে ডিবির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন আন্দোলনকারীদের ওপর অতিরিক্ত বল প্রয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার জরুরি বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন দুই মার্কিন সিনেটর মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার।