আর্থিক খাতে ঘুণপোকা
দিন দিন বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। মৃতপ্রায় কিছু ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। উচ্চপর্যায়ে ঝুঁকিতে দেশের অর্ধেকের বেশি বীমা কোম্পানি। গতি নেই রাজস্ব আহরণেও। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক বাণিজ্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে দেশের আর্থিক খাতের ওপর বড় চাপ তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে আর্থিক খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই সময়ে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট এবং দুর্নীতির ফলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও বারবার পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে এই খাতের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখা হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা খাতে। এতে ঘুণ ধরেছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সুশাসন ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানা অনিয়মের কারণে ডুবতে বসা আর্থিক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এটা নিয়েও রয়েছে নানা শঙ্কা। আইএমএফের বরাত দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে। গত বছরের আগস্টে যখন এই সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেখা গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, দেশের আর্থিক খাতের দুরবস্থা থেকে উদ্ধার হওয়া কঠিন। লুটেরারা টাকা লুট করে পালিয়েছে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অ্যাসেট ছাড়াই ঋণ দিয়েছে। ফলে দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বীমা কোম্পানিগুলো সাইনবোর্ড লাগিয়ে টাকা নিয়েছে। এখন গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা রয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হওয়ার ঘটনায় ব্যাংক ও কাস্টমসের সামষ্টিক ব্যর্থতা (কালেক্টিভ ফেইলিউর) রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক এবং ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের চেয়ারম্যান ড. শহীদুল জাহীদ আমাদের সময়কে বলেন, দেশের পুরো অর্থনৈতিক খাত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা কম দেখছি। এতে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি মন্দার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। যৌথ অডিটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। সুদের হার কমালে বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। এতে কর্মসংস্থানেও ইতিবাচক ভূমিকা আসবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
ভাবমূর্তি সংকটে ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান
জানা গেছে, ব্যাংকবহির্ভূত কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। পাচ্ছে না নতুন আমানতও। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের বড় অংশ অনাদায়ী হয়ে গেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এতে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। ১৫ থেকে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের ৯৯ শতাংশ ঋণখেলাপি। ব্যাংকাররা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকের সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া নানা অনিয়মে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য আর্থিক খাত পুনর্গঠন করতে হবে।
খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা
এদিকে, দেশের ব্যাংক খাতে চাপিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। এতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপির পরিমাণ ও হার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের মোট ঋণের যা প্রায় ৩০ শতাংশ। তিন মাস আগের তুলনায় যা এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর এক বছরে বেড়েছে তিন লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা বা ১৫১ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে। আবার নিয়ম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়, তার অনেকগুলো আদায় হচ্ছে না। অনিয়মের কারণে অনেক ঋণ খেলাপি করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অধরা
অন্যদিকে, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আহরণে করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে। বোর্ডের সাময়িক হিসাব অনুসারে, গত অর্থবছরে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা, যা এযাবৎকালের রেকর্ড। জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কারণে প্রায় দেড় থেকে দুই মাস ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল অচল। আবার অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এনবিআরের আন্দোলনের কারণে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটি। এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আসছে না।
ঝুঁকিতে অর্ধেকের বেশি বীমা কোম্পানি
দেশের মোট ৮২টি বীমাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আছে ঝুঁকিতে। জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা মিলিয়ে ৩২টি প্রতিষ্ঠান আছে উচ্চপর্যায়ের ঝুঁকিতে। আর ১৫টি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋণমান যাচাইকারী কোম্পানি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল জানিয়েছে, গত দুই বছরে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তবে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক লেনদেনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে আগামী এক বছরে প্রবৃদ্ধি গতি পেতে পারে। তাতে পরবর্তী তিন বছরে প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে।
এসঅ্যান্ডপি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ককে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঝুঁকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, এই শুল্ক কার্যকর হলে তা তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা ও শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখনও অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এখানে শ্রমের খরচ কম এবং শ্রমশক্তির সহজলভ্যতাও রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্ক হার বাংলাদেশকে ওই বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগকারীদের এখনও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, প্রতিষ্ঠানগত কাঠামোর পরিবর্তন, অবকাঠামোগত ঘাটতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বিনিয়োগকারীরা। যদি একটি নির্বাচিত সরকার গঠনের মাধ্যমে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়, তা হলে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের ভিত্তি গঠনে সহায়ক হতে পারে।