আ. লীগ নেতাদের লাইসেন্স করা অস্ত্রে ২২ হত্যাকাণ্ড
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা, এমপি ও মেয়রদের লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। হাসিনা পতন আন্দোলন দমাতে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি জান্নাত আরা হেনরির নামে লাইসেন্স করা অন্তত দুটি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ওই দুটি অস্ত্রই জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় গুলির প্রমাণ মিলেছে। রাজশাহীর বিভাগ থেকে এ রকম আরও ৩৫টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দের পর ফরেনসিক করা হয়েছে। জব্দ করা ৩৭টি অস্ত্রই আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে লাইসেন্স করা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এসব অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যাকা- সংঘটন করা হয়। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যা মামলাগুলো তদন্তের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন। অস্ত্রগুলো বিভিন্ন মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে জব্দ দেখানো হয়েছে। তবে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়ার মামলাগুলোর কোনোটিরই তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। পুলিশ বলছে, এই বিভাগের ২২টি হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের তথ্যমতে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতাকে হত্যার উদ্দেশে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র থেকেও গুলি ছোড়া হয়। এর মধ্যে ৩৪টি আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশ বিভিন্ন মামলায় জব্দ দেখিয়েছে। ঢাকায় সিআইডির ফরেসনিক ল্যাবে পরীক্ষা করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, অস্ত্রগুলো থেকে জুলাই-আগস্টে গুলি করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের মালিক আওয়ামী লীগ নেতারাই। এগুলোর মধ্যে সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরির নামে একটি শটগান ও একটি পিস্তুল রয়েছে। জব্দ করা ৩৭ আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে পাবনার ১০টি, বগুড়ার ৯টি, সিরাজগঞ্জের ৮টি, রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকার ৬টি এবং জয়পুরহাটের ৪টি।
ওই সময় বিভিন্ন ঘটনায় রাজশাহী বিভাগে ১১৮টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২২টি হত্যা মামলা। হত্যা মামলা সর্বোচ্চ ৯টি হয়েছে বগুড়ায়। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জে ৮টি, রাজশাহীতে ২টি, জয়পুরহাটে ২টি, পাবনায় ১টি হত্যা মামলা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় উত্তরাঞ্চলে সব থেকে বেশি মামলা হয়েছে রাজশাহীতে। রাজশাহী জেলার কোনো থানায় হত্যাকা-ের মামলা হয়নি। তবে অন্যান্য ধারায় মামলা হয়েছে ১৬টি। রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের তদন্তে রয়েছে দুটি হত্যাসহ ২৯টি মামলা।
আরও পড়ুন:
গণভবনে ডাক পেলেন আ. লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা
হত্যামামলা ছাড়াও রাজশাহী বিভাগের যে ৯৬টি মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে ২৭টি, জয়পুরহাটে ৮টি, বগুড়ায় ২৩টি, সিরাজগঞ্জে ৬টি, পাবনায় ৫টি, নাটোরে ৪টি, নওগাঁয় ৪টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি মামলা রয়েছে। এই বিভাগে ২২টি হত্যা মামলায় এজারভুক্ত আসামির সংখ্যা ১ হাজার ৯৪৯ জন। এসব মামলায় মোট গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৭৬ জন। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ১৭৯ জন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ১৯৭জন। রাজশাহী বিভাগের ২২ হত্যা মামলার মধ্যে ১২টি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলোর ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পুলিশ হাতে পেয়েছে। তবে বাদীর মত না থাকায় ১০টি মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে পারেনি পুলিশ।
হত্যা মামলাগুলোর অগ্রগতির বিষয়ে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) সারোয়ার জাহান বলেন, ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় মরদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত বা উপাদান। পুলিশের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য হত্যাকা-ের শিকার শহীদদের পরিবার বা মামলার বাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু ১০টি হত্যামামলায় আমরা ময়নাতদন্ত করাতে পারিনি। তবে হাসপাতাল থেকে দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াও মরদেহের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট হিসেবে কাজ করবে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করা হচ্ছে, যেন পরিবারগুলো ন্যায়বিচার পান।’
এদিকে পুলিশ বলছে, আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দায়ের হাওয়া বেশকিছু মামলায় অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। তদন্ত করতে গিয়ে বেশকিছু মামলা গুরুত্বপূর্ণ তালিকা থেকে বাদও দেওয়া হয়। গণ-অভ্যুত্থানের সময় ২২টি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধারার ১১৮টি মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি বিশেষ কমিটি মনিটরিং করছে। এরই মধ্যে এসব মামলার ছয়টির তদন্ত শেষ করেছে পুলিশ। আগামী মাসের মধ্যেই আরও একাধিক হত্যা মামলার পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন জমা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, সব মামলাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলাসহ ১০টি মামলা প্রথম ধাপে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন খুঁটিনাটি বিষয় দেখা হচ্ছে। আগামী ৫ আগস্টের মধ্যেও তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছি। তিনি আরও জানান, প্রকৃত যারা অপরাধী তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। যারা এসব ঘটনায় ছিল আমরা তাদের চিহ্নিত করে ফেলেছি। আমরা কিছু ভিডিও ফুটেজ ফরেনসিক করানো হচ্ছে।
মামলার অগ্রগতি বিষয়ে সন্তোষ জানিয়ে রাজশাহীর শিক্ষার্থী শহীদ সাকিব আনজুমের বাবা মাইনুল হক বলেন, প্রথম দিকে এই মামলার তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও এখন পুলিশের কার্যক্রমে স্বস্তিজনক। আগে যারা পুলিশের পক্ষ থেকে মামলাটি দেখছিল তারা বিগত সরকারের দোসর ছিল। তবে এখন যারা পুলিশে কাজ করছেন, তাদের কাজের গতি ভালো। শেষ পর্যন্ত বিচারে খুনিরা শাস্তি পেলেই স্বস্তি মিলবে।