আপনকে যাতে পরের দয়ায় বাঁচতে না হয়

পিতা-মাতার আকুতি

রফিকুল ইসলাম, যশোর
২৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আপনকে যাতে পরের দয়ায় বাঁচতে না হয়

‘আমার সন্তানটা হয়তো আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। কোনো কাজ করে জীবন চালাতে পারবে না। আমাদের অবর্তমানে সারাজীবন হয়তো পরের গলার কাঁটা হয়ে থাকতে হবে। তাকে যেন পরের দয়ায় বাঁচতে না হয়। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত। কিন্তু আমাদের তো উপরমহলে লোক নেই। তাই ছেলেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি।’Ñ এভাবে কথাগুলো বলছিলেন জুলাইযোদ্ধা আবদুল হাকিম আপনের মা লাবনী বেগম।

যশোর শহরের নাজির শংকরপুরের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে শেখ জাহাঙ্গীর ও লাবনী বেগম দম্পত্তি। জাহাঙ্গীর পেশায় ট্রাকচালক। তাদের দুই সন্তানÑ আপন ও সোহান। বড় ছেলে আপন ফরিদপুরে একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে সোহান শহরের একটি মোটর পার্টস দোকানের স্বল্প মজুরির কর্মচারী।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যশোর শহরের চাঁচড়া চেকপোস্টে মহাসড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। আপন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ওই দিন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরে মানুষ আনন্দ মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়ে শহরে। মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করতে থাকে। এরই মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্র চিত্রা মোড়ে অবস্থিত যশোরের আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের এমপি শাহিন চাকলাদারের মালিকানাধীন হোটেল জাবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের কারণে বহু মানুষ হোটেলে আটকে পড়েন। পরে ছাত্র-জনতাই আটকে পড়াদের উদ্ধারে নেমে পড়ে।

আপন বলেন, হোটেল জাবিরের পাশেই অবস্থিত ওজোপাডিকো (বিদ্যুৎ) অফিস থেকে মই নিয়ে আমরা কয়েকজন আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে থাকি। কয়েকজনকে জীবন্ত উদ্ধার করতে সক্ষম হই। একসময় মানুষের ভারে মই ভেঙে ছয়জন নিচে পড়ে যাই। এর পর আর কিছু বলতে পারি না। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে দেখি হাসপাতালের বেডে। পরে শুনি আমাদের মধ্যে ঘটনাস্থলে দুইজন ও হাসপাতালে আরও দুইজন মারা গেছেন। বাবা শেখ জাহাঙ্গীর বলেন, দুর্ঘটনার

পর আপনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায় ছাত্র-জনতা। মেরুদণ্ডের হাড়, স্পাইনাল কর্ড ও নিতম্ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার এ হাসপাতালে চিকিৎসা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন ডাক্তাররা। এর পরের দিনই তাকে রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেখানে অজ্ঞাত কারণে ভর্তি নেয়নি।

শেখ জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ঢাকা থেকে ফিরিয়ে এনে যশোরের প্রাইভেট ‘পঙ্গু হাসপাতালে’ ডা. এএইচএম আব্দুর রউফের তত্ত্বাবধানে আপনের মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। অপারেশনের পরও ছেলে আর দাঁড়াতে বা বসতেও পারেনি। ঘটনার সাত মাস পর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ফোন করে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠায়। এক সপ্তাহ পর সেখানে আর চিকিৎসা সম্ভব নয় জানিয়ে কর্তৃপক্ষ ঢাকার সাভারে অবস্থিত ‘সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড’ (সিআরপি) সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। একটানা প্রায় চার মাস সেখানে চিকিৎসা চলছে আপনের। কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররাও আশার বাণীর শোনাতে পারছেন না।

ট্রাকচালক জাহাঙ্গীর বলেন, ছেলেটার চিকিৎসায় এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৪ লাখ টাকা। জুলাই ফাউন্ডেশন ১ লাখ ও জেলা পরিষদ থেকে ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ট্রাক চালিয়ে যা পাই, তার প্রায় সবই প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হয়। এর পরও আমি ২ লাখ টাকা দেনা হয়ে গেছি। এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। কেউ কথা শোনেও না। ছেলে এখনও হাসপাতালে। দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার সুস্থ হওয়ার কোনো লক্ষণ বা আশার বাণী কেউ শোনাতে পারছে না। এমন এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে আছি। সরকারের সাহায্য সহযোগিতা না পেলে আমার চার সদস্যের সংসার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

জাহাঙ্গীর-লাবনী দম্পতি বলেন, বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করালে ছেলে হয়তো আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতো। তাই সরকারের কাছে আর্থিক সহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। আপনকে যাতে সারাজীবন পরের দয়ার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে না হয়, এ জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে তার জন্য একটা ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন তার বাবা-মা।