সীমাবদ্ধতা অনিয়ম অপচয়ে মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ফল
প্রকল্পের নাম ‘দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান’। এ প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে তিন মাস মেয়াদি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্পের সুফল মেলেনি নানা সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম আর অপচয়ের কারণে।
জানা গেছে, প্রশিক্ষণকালে বিদেশি ভাষা শেখানোর কথা থাকলেও প্রশিক্ষণার্থীদের তা শেখানো হয়নি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে নেই গাড়ি চালনার পর্যাপ্ত স্থান, নেই নিজস্ব মাঠ। অন্য মাঠে অনুশীলন করতে গেলে পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। মাত্র ৫-৭ মিনিট গাড়ি চালনার সুযোগ পাওয়া যায়, যা যথেষ্ট নয়। প্রশিক্ষণে শুধু ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ি ব্যবহার করা হয়। অথচ বাস্তবে অটো গিয়ারের গাড়িও চালাতে হয়। এ ছাড়া সব টিটিসিতে দাল্লাহ আল বাকার টেস্টিং পরীক্ষা না নেওয়া, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, প্রকল্প শুরুর পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো নিরীক্ষা না হওয়াসহ নানা ধরনের অসঙ্গতি পেয়েছে সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রকল্পের ওপর আইএমইডি পরিচালিত নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা বেগবান করার পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ জনশক্তিকে সত্যিকারভাবে মানবসম্পদে রূপান্তর করা। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। দারিদ্র্য বিমোচন, দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিল্প সহায়ক দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ বৃদ্ধি ইত্যাদি কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করাই কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। এরই ধারাবাহিকতায় দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান শীর্ষক প্রকল্পটির ডিপিপি ২৬৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৫ বছর বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়। পরে ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ দেশ-বিদেশে, বিশেষ করে সৌদি আরবে ড্রাইভিং পেশায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দেশ-বিদেশে পেশাদার ড্রাইভারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১০৪ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ড্রাইভিং উইদ অটোমেকানিক্স প্রশিক্ষণ প্রদান। প্রকল্পের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে মোটরযান ক্রয়, প্রশিক্ষণ, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ও।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৩৬টি মোটরযান ক্রয়। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ১১৩টি যানবাহন ক্রয় করা হয়েছে, অবশিষ্ট ২৩টি যানবাহন এখনও ক্রয় করার অনুমোদন অর্থ মন্ত্রণালয় দেয়নি। ওই যানবাহনগুলো আরও ৪০টি সিম্যুলেটরসহ আরডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নতুনভাবে নির্মিত ৪০টি টিটিসিতে শিগগিরই ক্রয় করে দেওয়া হবে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জীভূত আর্থিক অগ্রগতি ১৩১ কোটি ৫৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং বাস্তব অগ্রগতি ৪৯.২১ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় মোট ১ লাখ ২ হাজার ৪শ প্রশিক্ষণার্থীকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩টি ব্যাচে মোট ৫০ হাজার ৫৯১ জন প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৫৫৭ প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ করেছেন আর ড্রপ আউট হয়েছেন ৩ হাজার ৬৩৭ প্রশিক্ষণার্থী। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে নারী ছিলেন ২ হাজার ২৭১ জন। এ ছাড়া ২৪৭ প্রশিক্ষণার্থী ভারী লাইসেন্স প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪৫ জন কোর্স শেষ করেছেন এবং ১৩৬ জন বিআরটিএ কর্তৃক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কোর্স সম্পন্নকৃত প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৬১১ জন লাইসেন্স পেয়েছেন, যার শতকরা হার ৮৩.২৯ শতাংশ। যেসব প্রশিক্ষণার্থী ইতোমধ্যে লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৪৪০ প্রশিক্ষণার্থী দেশে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত আছেন; ১২ হাজার ২৩ প্রশিক্ষণার্থীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় যেসব প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রদান করা হবে, তাদের টেস্টিং ও লাইসেন্স প্রদানের জন্য সৌদি আরবস্থ দাল্লাহ আল বাকারার সঙ্গে আলোচনা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষিত ড্রাইভারদের পরীক্ষা গ্রহণ ও লাইসেন্স প্রদান করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা তেমন একটা পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ঢাকায় মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দাল্লাহ আল বাকার কর্তৃক ৭ জনকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
প্রকল্পের আরডিপিপি অনুযায়ী ১১টি পণ্য ও একটি সেবা প্যাকেজসহ মোট ১২টি প্যাকেজ রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় প্যাকেজেরই ক্রয় সম্পন্ন হয়েছে। ক্রয় কার্যক্রমে কোনো ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়নি। সমগ্র বাংলাদেশের ৬৪টি টিটিসি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ২৬৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকার প্রকল্পটি ৫ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। পরিকল্পনা বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প পরিচালনার জন্য ৬০টি এডিপি, ২০টি পিআইসি ও ১০টি পিএসসি সভা আয়োজন করার কথা নির্ধারিত ছিল। বাস্তবে ৫৭টি এডিপি, ১৪টি পিআইসি ও ১৩টি পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী করা হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পিছিয়ে থাকা, ডিপিপি/আরডিপিপি অনুযায়ী যথাযথভাবে অর্থ ছাড় না হওয়া, বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ভাষা শিক্ষা প্রশিক্ষণ যথাযথভাবে না হওয়া, প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য গাড়ি অনুশীলন সময় কম হওয়া, দাল্লাহ আল বাকার কর্তৃক সব টিটিসিতে টেস্টিং পরীক্ষা না নেওয়া, যেসব টিটিসিতে ২ ব্যাচে প্রশিক্ষণ চলমান, সেখানে প্রশিক্ষণার্থীর তুলনায় অনুশীলন গাড়ি অপ্রতুল এবং ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।