দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে অগ্নিঝরা প্রতিবাদ

নজরুল ইসলাম
২৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে অগ্নিঝরা প্রতিবাদ

গত বছরের ২৮ জুলাই সারাদেশে দেয়াল লিখন, গ্রাফিতি আর অনলাইন-অফলাইনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয় অগ্নিঝরা প্রতিবাদ। তবে ঢাকায় দেয়াল লিখনের সময় পুলিশ বাধা দেয়। এর আগে ২৭ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। তাদের দাবি ছিল- কোটা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সংসদে পাস করতে হবে। একই সঙ্গে তারা দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকার কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তবে ২৭ জুলাই রাতে ডিবি হেফাজতে থাকা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ভিডিও বার্তায় এ কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলেন। অন্য দুজন সমন্বয়ক জানান, তাকে জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এমন ভিডিও দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এরপর আব্দুল কাদের নামে এক সমন্বয়ক সংবাদ মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে জানান, ২৮ জুলাই সারা দেশে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করবে। সেদিন বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ২৬৬ জন নিহত হয়েছেন। তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের নামে করা সব মামলাই মিথ্যা।

বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা এবং বাংলাদেশ জাসদ ওই দিন দাবি জানায়, সংঘর্ষে কারা নিহত হয়েছেন, তার তালিকা প্রকাশ করতে হবে। যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার করতে হবে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ২৭ জুলাই সচিবালয়ে বলেন, কোটা আন্দোলনে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন। এর আগের দিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জানায়, নির্বিচারে হত্যা ও গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।

এদিন রাতে পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে যান চারুকলার ছাত্ররা ও কার্টুনিস্টরা। কিন্তু পুলিশ তাদের বাধা দেয়। রংতুলি জব্দ করে নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ অনেক জায়গায় দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকা হয়।

গ্রাফিতিতে খো হয়- ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’, ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘সেভ দ্য কান্ট্রি জয়েন দ্য ফাইট’, ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে অন্যদিকে গুম করে’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’, ‘সম্পদের হিসাব পরে, লাশের হিসাব আগে’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যান?’ ইত্যাদি লেখা হয়। গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছে ছাদে গিয়ে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়ার কথাও।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গ্রাফিতিতে আবু সাঈদকে আঁকেন- যিনি হাত উঁচিয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। এদিন ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের পরিবারের কয়েকজন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ভোরে আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে মিরপুর থেকে ধরে নিয়ে যায় ডিবি। তার বাসার গেট ভেঙে তাকে তুলে নেওয়া হয়।

এদিকে, প্রায় ১০ দিন বন্ধ থাকার পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক বন্ধই থাকে। বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। তারা জাবির শিক্ষার্থী ও সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের মুক্তি দাবি করেন।

রাত ১১টার দিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও ২৯ জুলাই রাজপথে নামার ঘোষণা দেন। ফেসবুকে তারা জানান, ৯ দফা দাবি মানা না হলে আন্দোলন চলবে। এদিন রাতে ডিবি কার্যালয়ে প্রায় দুই দিন হেফাজতে থাকার পর খাবার টেবিলে সমন্বয়কদের সামনে খাবার দিয়ে ছবি তোলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ।

২৭ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমের উদ্বেগ সরকার দেখেছে। অপপ্রচার ও ভুল তথ্য ছড়ানোর সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই সমর্থনে সরকার কৃতজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু জানান, তারা বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে কারফিউ দেওয়া হয়েছে এবং পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়েছে।

২৮ জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়) আহতদের দেখতে যান। এর আগে সকালে গণভবনে নিহত আবু সাঈদসহ ৩৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেন তিনি।

এই সময় কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশে গ্রেপ্তার চলতে থাকে। ২৭ জুলাই পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকায় ওই দিন সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় নতুন করে ২২টি মামলা হয়। সব মিলিয়ে ঢাকায় মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৯। মোট গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ৭৬৪ জন।