লক্ষ্য পূরণ হয়নি বেসরকারি ঋণে
বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও তলানিতে নেমেছে। গত জুন শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ, যা এ যাবতকালের সর্বনিম্ন। আগের মাসে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এই প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এটি চলতি মুদ্রানীতিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। ধারাবাহিকভাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি সুদহারের ক্রমাগত বৃদ্ধি, তারল্য সংকট ও ডলারের স্বাভাবিক জোগান নিশ্চিত না হওয়াকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।
ব্যাংকাররা জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কমেছে ব্যবসায়ীদের। আওয়ামী লীগ আমলের ব্যবসায়ীদের অনেকেই আত্মগোপন করেছেন। ডলার সরবরাহ পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি চালু রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েছে। সেই সঙ্গে পর্ষদ পুনর্গঠন করা ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটের কারণে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রেখেছে। এসব কারণে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে নিম¥মুখী প্রবণতা চলছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতির স্থিতিশীলতার অভাবে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। ফলে ঋণের চাহিদা কমেছে, বিনিয়োগ থমকে গেছে। নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু ধারবাহিক পতনে এই লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ দূরে রয়েছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত জুন শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, ২০২৪ সালের একই সময় যা ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছর ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৮ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত এ খাতে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, এখন বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা ও অনিশ্চয়তা দুটোই রয়েছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক নীতিতে আছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক হলে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে। তবে সবকিছুই যে ঠিক হবে তা নয়। কারণ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে জঞ্জাল রয়েছে, তা আগে দূর করতে হবে। এ সরকার সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামীতে বিনিয়োগ বাড়বে।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহারও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। যেখানে একসময় এ হার ছিল ৮ থেকে ৯ শতাংশ। সুদের এ ঊর্ধ্বগতি ব্যবসায়িক ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া গত অর্থবছরজুড়ে ডলারের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। এ কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কমেছে ব্যবসায়ীদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি ও নিস্পত্তি কমেছে যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ও ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিও কমেছে যথক্রমে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ ও ৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ধীরগতির কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এর মূলে ছিল ডলারের দামসহ আরও কিছু কারণ। তবে এখন ডলারের জোগান স্বাভাবিক হয়েছে। দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। ফলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে গতি আসবে। এতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়বে।