কাঙ্ক্ষিত অর্জনে সম্ভাবনার সঙ্গে রয়েছে সংশয়ও

রেজাউল রেজা
২৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
কাঙ্ক্ষিত অর্জনে সম্ভাবনার সঙ্গে রয়েছে সংশয়ও

২০২৪-২৫ অর্থবছরের রপ্তানি আয় নিয়ে বড় প্রত্যাশা থাকলেও নানা বাধা ও প্রতিকূলতায় তা ছুঁতে পারেননি রপ্তানিকারকরা। অর্থবছর শেষে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির আশা করা হলেও রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮.৫৮ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৪৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার। নানা সংকটের মধ্যেও এই প্রবৃদ্ধিকে সন্তোষজনক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর নিয়েও আশাবাদী তারা। তবে সম্ভাবনার মাঝে সংশয়ও রয়েছে। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জ্বালানিসহ বেশ কতগুলো চ্যালেঞ্জ দেখছেন তারা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা সংকটে শিল্প-কারখানাগুলোতে বারবার উৎপাদন হোঁচট খাচ্ছে। একদিকে নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত জ্বালানির অভাব, অন্যদিকে শ্রমিক আন্দোলন, বিশৃঙ্খলা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে। এতে গত অর্থবছরে উৎপাদন ও রপ্তানির স্বাভাবিক গতি বারবার ব্যাহত হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবছরের শেষ দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন গত জুন মাসের আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। জুনে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশেরও বেশি। এ কারণে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও এক অঙ্কের ঘরে আটকে গেছে। ইপিবির সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত জুনে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরে ছিল ৩.৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গোটা অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হলেও জুনে রপ্তানি ৭.৫৫ শতাংশ কমেছে।

দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এ খাতে আয় হয়েছে ৩৯.৩৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৮.৮৪ শতাংশ বেশি। এ খাতেও গত জুনে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আগের অর্থবছরের জুনের চেয়ে ৬.৩১ শতাংশ কম আয় এসেছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১০ শতাংশের প্রবৃদ্ধি ছোঁয়ার প্রত্যাশা থাকলেও সম্ভব হয়নি। সেটার পেছনে কিছু কারণ ছিল। গত বছর জুলাই ও আগস্টে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবির হয়ে যায়, পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা এবং শেষ দিকে এনবিআরের অচলাবস্থা। তারপরও প্রবৃদ্ধি এসেছে। সেটা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় সন্তোষজনক। কিন্তু আগের দুই অর্থবছরের তুলনায় সন্তোষজনক বলা যাবে না। নতুন অর্থবছরেও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি। তিনি বলেন, দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফটা কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। ট্যারিফ ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে মোকাবিলা করতে পারব, বেশি হলে কঠিন হবে। আবার ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে যদি কম কিংবা সমান হয়, তাহলে ক্ষতিটা কম হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আরেকটা চ্যালেঞ্জ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের রপ্তানিতে অর্জন ও নতুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সম্ভাবনার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরটা অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। কেবল জুলাই-আগস্ট নয়, এর পরেও বিশৃঙ্খলা, শ্রমিক অসন্তোষ, আন্দোলনের কারণে কারখানাগুলো ঠিকমতো কাজ করছিল না। এরপরও প্রত্যাশা ছুঁতে না পারলেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু নতুন অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কিনা সংশয় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শিল্প খাতে জ্বালানি সমস্যা দীর্ঘদিনের। উৎপাদনের গতি ধরে রাখাটাই মস্ত চ্যালেঞ্জ। আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ডাকছি, অথচ নিজেদের শিল্পকারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করছি না। জ্বালানির জ্বালার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের জ্বালা, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার। আমাদের বড় প্রতিযোগী ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার কত হবে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ট্রাম্পের এই ট্যারিফ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়লে সেটারও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের বন্দরগুলোর গতি আরও বাড়াতে হবে।

তিনি যোগ করেন, বর্তমানে একটিই ভালো সংবাদÑ বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম কমছে। এতে চাহিদা বাড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্য দেশগুলোতে আমাদের রপ্তানিবাজারের জন্য ভালো।

ইপিবির তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি আরও অনেক খাত প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেছে। এর মধ্যে হোম টেক্সটাইল খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২.৪২ শতাংশ। কৃষিপণ্যে প্রবৃদ্ধি ২.৫২ শতাংশ। হিমায়িত মাছের রপ্তানি বেড়েছে ১৭.২৩ শতাংশ। প্লাস্টিক পণ্যে বেড়েছে ১৬.২১ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ১০.১৯ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে হিমায়িত মাছ বাদে বাকি খাতগুলোতে গত জুন মাসে রপ্তানি আয় কমেছে।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হলে বারবার উৎপাদন ব্যাহত হয়, সেই সঙ্গে কাঁচামালের অপচয় বেড়ে যায়। এটাই আমাদের বিরাট সমস্যা। রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও ব্যবসায়ীদের শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও বেশি প্রবৃদ্ধি সম্ভব ছিল। বিভিন্ন সংকটের কারণে তা অর্জন হয়নি। নতুন অর্থবছরে বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সরকারের পক্ষ থেকে শুল্কে যে ছাড় ছিল তা কমানো হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের খরচ বিশেষ করে কার্গো ভাড়া অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় শাকসবজিসহ এ ধরনের পণ্যের রপ্তানি আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।