রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় ফাঁক

শাহজাহান আকন্দ শুভ
২৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় ফাঁক

গত মঙ্গলবার একদল শিক্ষার্থী প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা দায়িত্বরত পুলিশকে মারধরসহ ভেতরে পার্কিং করা গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তায় ঝুঁকির দিকটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। শুধু সচিবালয় নয়, প্রসঙ্গক্রমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসছে।

গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে মানুষ। কথায় কথায় তারা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাওয়ের পাশাপাশি ক্ষতিসাধনও করছে, যার সর্বশেষ উদাহরণ আব্দুল গনি রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ সচিবালয়। এমন প্রেক্ষাপটে সচিবালয়সহ কেপিআই (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি ঢেলে সাজানোর তাগিদ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কেপিআই তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে মোট ৫৯৪টি। এর মধ্যে বিশেষ শ্রেণির কেপিআইভুক্ত স্থাপনা হলো রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের অফিস এবং বাসভবন। সে মোতাবেক বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা বিশেষ শ্রেণির রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আর প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষিত এলাকা। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২২ ধারা মোতাবেক সরকার এটি সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন বা সরকারি আদেশ জারি করেছিল। সে মোতাবেক সচিবালয়ের নিরাপত্তা কেপিআই তালিকাভুক্ত স্থাপনা হিসেবে নয়, সুরক্ষিত এলাকা হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা দেখভাল তথা তদারকির দায়িত্ব পালন করে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গত মঙ্গলবার বিকালে বিক্ষুব্ধ একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও পুলিশকে মারধর করে। ঘটনার সময় সচিবালয়ের ভেতরে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে সচিবালয় আক্রান্ত হওয়ায় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা নিয়ে। ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো, আতাউর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, গত মঙ্গলবারের ঘটনার পর সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করতে করণীয় নির্ধারণে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া সচিবালয়ের পাঁচটি গেট আরও কীভাবে শক্তিশালী ও সুরক্ষিত করা যায়, এ কাজটি করবে গণপূর্ত বিভাগ।

মঙ্গলবারের ঘটনার বিষয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বিমান দুর্ঘটনায় সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে হতাহতের ঘটনার পর সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা বাস্তবতা এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়েছে। এ ছাড়া ওই দিন শিক্ষার্থীদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল না সেখানে। কিন্তু যখন তারা আইন অমান্য করতে শুরু করে, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিবৃত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রটেকশন অ্যান্ড ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগের যুগ্ম কমিশনার সানা শামীনুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, সেদিনের ঘটনার পর এখন সচিবালয়ের নিরাপত্তার দিকটা ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। সচিবালয়ের কোথাও ফোর্স বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় সচিবালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আসে। তখন বিশেষজ্ঞরা সচিবালয়ের নিরাপত্তা জোরদারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অগ্নিকা-ের ঘটনার আগে-পরে বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে আরও একাধিকবার সচিবালয়কে লক্ষ্য করে প্রধান ফটকের সামনে ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল একাধিক স্বার্থান্বেষী মহল। এমন কী জোরপূর্বক ভেতরে ঢুকে পড়ার ঘটনাও ঘটে। যেটা বিগত বছরগুলোয় দেখা যায়নি।

শুধু সচিবালয় নয়, গত বছর দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশেষ শ্রেণির রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বঙ্গভবন এবং হেয়ার রোড প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনেও বিভিন্ন সময়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে একাধিক গোষ্ঠী ও সংগঠন। এতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়। হেয়ার রোড ও আব্দুল গনি রোড এলাকায় সভা, সমাবেশে পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা কোনো পক্ষই মানছে না। আবার তাদের ওপর শক্ত আইন প্রয়োগ করতেও দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এর আগে পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আরও বেশ কয়েকটি স্থাপনায় বিভিন্ন পক্ষ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে ওই সব প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করে। বাধ্য হয়ে সেসব স্থানে সেনাবাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে হয়।

সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) আশরাফুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর শক্তভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না পুলিশ। এই সুযোগে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিশৃঙ্খলা করছে। এমন কী সচিবালয়ের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে বিশৃঙ্খলা করছে। এই অবস্থা কারও কাম্য নয়। উন্নত দেশে মানুষ আইন মান্য করে চলে আর আমাদের দেশে প্রয়োগ করতে হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশকে শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু সেটাতো আমরা দেখছি না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অতি দ্রুত অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার দরকার।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনাতেই পর্যাপ্ত পরিমাণ সিসি ক্যামেরা নেই। নেই অন্যান্য নিরাপত্তা সামগ্রী। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা রক্ষীও নেই। নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। এ ছাড়া সীমানাপ্রাচীর যে উচ্চতায় থাকার কথা তা নেই। আবার সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে নানা বেসরকারি স্থাপনা। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের সময় সময়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার পুলিশের বিশেষ শাখা দিয়ে পর্যবেক্ষণও করা হয়ে থাকে।