স্বৈরশাসনের পথ করে দেন খায়রুল হক

তাবারুল হক
২৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
স্বৈরশাসনের পথ করে দেন খায়রুল হক

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের পথ সুগম করে দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। সংবিধান সুরক্ষার শপথ ভঙ্গ করে রাজনৈতিক ইস্যুকে আদালতে টেনে এনে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করে। আইনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা বাতিল করেন খায়রুল হক। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভোটারবিহীন নির্বাচনের পথ সুগম করে দেওয়া হয় এবং এর সুবাদেই টানা ১৬ বছরেরও বেশি ক্ষমতায় চেপে বসেন শেখ হাসিনা।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৭ মে অবসরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায় দেন খায়রুল হক। এ রায়ের পর বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতেও বিক্ষোভ করেন আইনজীবীরা; সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিদায়ী সংবর্ধনাও নিতে পারেননি তিনি। অবসরে থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই খায়রুল হককে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষেও কয়েক দফায় পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন খায়রুল হক।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। দেশের ঊনবিংশতম প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় মামলা করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী ভূঁইয়া। মামলায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায়ও তাকে আসামি করা হয়েছে।

খায়রুল হককে গ্রেপ্তারের পর আইনজ্ঞরা বলছেন, সর্বোচ্চ বিচারকের আসনে বসে তিনি যেসব অপকর্ম করেছেন, তা অমার্জনীয়। দেশ ও জাতিকে তিনি কলঙ্কিত করেছেন। তার বিচারের মাধ্যমে এমন নজির সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন যেন ভবিষ্যতে বিচার বিভাগে নতুন কোনো খায়রুল হকের জন্ম না হয়।

এই খায়রুল হকই রায় দেন- জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষক। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে চরম দলীয়করণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনজ্ঞরা আরও বলছেন, খায়রুল হকের লক্ষ্যই ছিল বিচারকের আসনে বসে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।

২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন এ সরকারের অধীনেই হবে। কিন্তু অবসরে গিয়ে লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ অংশটুকু বাদ দেন বিচারপতি খায়রুল হক। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জালিয়াতি আর কখনো হয়নি বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তারা বলছেন, এর মাধ্যমেই দেশে স্বৈরাচার তথা ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটে।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচারকরা যে শপথ নেন তাতে বলা আছে, কোনো রকম অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক বরং অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। ওপেন কোর্টে ঘোষণা করা একটি রায় তিনি পূর্ণাঙ্গ আদেশে পরিবর্তন করে ফেলেন। এর মাধ্যমে নজিরবিহীন ‘জুডিশিয়াল ফ্রড’ করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের মাধ্যমে বিচারপতি খায়রুল হক এ দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেন, সেখানে শুধু একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তিনি আইনের অপপ্রয়োগ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেন। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বহু বছর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এর প্রধান কারিগরই ছিলেন খায়রুল হক।

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, খায়রুল হকের কারণে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ বছরের পর বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তার বিচারিক জীবনে এবং পরবর্তী সময়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশে বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। সাবেক এই প্রধান বিচারপতির বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত, রায় ও পদক্ষেপ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। তিনিই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেশে সংঘাতের সৃষ্টি করেছিলেন।

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আওয়ামী লীগের সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে থাকার উদ্দেশ্যে খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে শহীদ জিয়ার স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন খায়রুল হক। বিচারিক অসাধুতার নগণ্য নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিনিময়ে বিচারপতি খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তার এমন বিচার হওয়া প্রয়োজন যেন এ বিচার দেখে অন্য বিচারপতিরাও সাবধান হয়ে যান।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পর ২০০৯ সালের ২১ জুন হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন- জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক। হাইকোর্টের সেই বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি ছিলেন এই খায়রুল হক। এমনকি রায়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খ- পর্যন্ত বাতিল ঘোষণা করা হয়। খ-টি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, খায়রুল হক বিচারের নামে অবিচার করে গেছেন। যে দলের প্রতি তার আনুগত্য ছিল, প্রত্যেকবারই তিনি সেই দলের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন তার আচরণে, তার শারীরিক ভাষায়, তার দেওয়া রায়ে এটি পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অথচ এগুলো একজন বিচারপতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হওয়া উচিত ছিল।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, দেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর প্রধান নকশাকার সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে বিচারাঙ্গনে নতুন কোনো খায়রুল হকের জন্ম না হয়।

১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান এবিএম খায়রুল হক। এর দুই বছর পর স্থায়ী হন তিনি। আপিল বিভাগের দুজন বিচারপতিকে ডিঙিয়ে ২০১০ সালের ১ অক্টোবর তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।