‘নাই তুমি নাই, দিন তো এসব ভুলে যায়’

বিনোদন প্রতিবেদক
২৪ জুলাই ২০২৫, ১৭:৩২
শেয়ার :
‘নাই তুমি নাই, দিন তো এসব ভুলে যায়’

সংগীতের পরিচিত মুখ শাফিন আহমেদ। গেল বছর এদিন (২৪ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দিনটিও ছিল বৃহস্পতিবার। মাত্র ৬৩ বছর বয়সেই মারা যান তিনি। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ফিরে দেখা যাক- ব্যান্ড মাইলস’র প্রথমদিকের গল্প এবং সেসময়টা ব্যান্ড সংগীতের জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?

সংগীতের কিংবদন্তি কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগমের সন্তান শাফিন আহমেদ। এমন পরিবারে জন্ম নেওয়ায় সুর ছিল তার রক্তে। শৈশবে বাবা-মায়ের কাছেই সংগীতে হাতেখড়ি। বাবার কাছে শাস্ত্রীয়সংগীত ও তবলা শিখেছেন, আর মায়ের কাছে নজরুলসংগীত। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশি শেখা হয়নি, কারণ তার নিজের ভাষায়, ‘ছোটবেলায় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেওয়া, এগুলোতেই ইচ্ছে বেশি ছিল।’

তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পেয়েছিলেন পরিবারেই। এক সাক্ষাৎকারে শাফিন বলেছিলেন, ‘আমার জন্মের সময় থেকেই কিন্তু আমি এ রকম একটা ঘরে বা পরিবারে বেড়ে উঠেছি, যেখানে ছোটকাল থেকে গান শোনা হচ্ছে, ওইটা কিন্তু বিরাট শিক্ষা।’

সংগীত পরিবারে বেড়ে ওঠা এই ব্যান্ডশিল্পীর কৈশোর থেকেই পাশ্চাত্য রকসংগীতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন। ডিপ পার্পল, পিঙ্ক ফ্লয়েড, লেড জেপেলিনের মতো কালজয়ী ব্যান্ডের গান তাকে প্রভাবিত করে। শুরু হয় গিটার হাতে তুলে নেওয়ার সেই উশৃঙ্খল অধ্যায়। হাসতে হাসতে শাফিন বলতেন, ‘বাসার ড্রইং রুমে হয়তো পুরো ড্রামসেট লাগানো রয়েছে, গেস্ট আসছে, কি যাচ্ছে কার কি সমস্যা সেটার দিকে কোনো খেয়াল নাই। এভাবে গানগুলো তুলতে শুরু করলাম।’

আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার কিংবদন্তি বাবা-মা শাস্ত্রীয় সংগীতের হলেও তাকে কখনও বাধা দেননি। বরং সমর্থন জুগিয়েছেন। মা বিদেশ থেকে গিটার কিনে এনেছেন আর বাবা, যাকে তিনি ভাবতেন শুধু দেশীয় সংগীতের মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছিলেন গিটার টিউন করার কলাকৌশল।

একদিকে বন্ধুদের সঙ্গে রক মিউজিক করছেন শাফিন, অন্যদিকে টেলিভিশনে বাবার সুর করা ক্লাসিক গান কিংবা মায়ের সাথে নজরুলসংগীত গাইছেন। কলকাতার এক অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করে তিনি জানিয়েছিলেন, মা ফিরোজা বেগমের সঙ্গে ‘ঘুমেরও ছায়া চাঁদের চোখে’ গানটি ডুয়েট গেয়েছিলেন- মা উর্দুতে, আর তিনি বাংলায়। সেখানকার পত্রিকায় পরদিন শিরোনাম হয়েছিল, ‘মায়ের সংগীতে মুগ্ধ, ছেলের গানে স্তব্ধ!’

আশির দশকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শোতে সপ্তাহে পাঁচ দিন ইংরেজি কাভার সং গাইত মাইলস। সেখানেই মূলত ব্যান্ডের ভিত্তি গড়ে ওঠা। একসময় পড়াশোনার জন্য লন্ডনে পাড়ি দেন শাফিন। নব্বইয়ের দশকে সেখান থেকে ফেরার পর বাংলা গান করার সিদ্ধান্ত নেয় মাইলস। ভক্তদের প্রত্যাশা ও সময়ের দাবি মিলিয়ে ১৯৯১ সালে মুক্তি পায় তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রুতি’। যেখানে ছিল ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘প্রথম প্রেমের মতো’ গানগুলো।

শাফিনের মতে, এই অ্যালবাম বাংলা ব্যান্ডসংগীতের ধারাকেই বদলে দিয়েছিল। বাংলা সংগীত জগতে তৈরি করেছিল নতুন এক মানদণ্ড।

এরপর ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘প্রত্যাশা’। এই অ্যালবাম আগের সব সাফল্যকে ছাপিয়ে যায়। ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘নীলা’, ‘জাদু’, ‘হৃদয়হীনা’র মতো গানগুলো মাইলসকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

তবে সেই সময়ে বাংলা সংগীতে ব্যান্ড শিল্পীরা ছিল রীতিমতো ব্রাত্য। নানা সমালোচনা আর কটূক্তি সইতে হয়েছে তাদের। সেই দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে শাফিন বলেছিলেন, ‘সমালোচনার সংখ্যা অনেক বেশি ছিল শুরুর দিকে। যুদ্ধটা খুব কঠিন যুদ্ধ ছিল। কোনো সাপোর্ট পেতাম না। অত্যন্ত কঠিন সমালোচনা হতো এবং কেউ কোনো কিছু বলতে দ্বিধা করেনি। যারা ব্যান্ড সংগীতের সাথে অভ্যস্ত ছিল না শুরুর দিকে, তাদের সেটা হতেই পারে। কিন্তু মেনে নেওয়া বা সহজে জিনিসটাকে গ্রহণ করার মানুষ কমই ছিল। সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে ছিল, তারা কিন্তু সহজে জিনিসটাকে লুফে নিয়েছে। সমস্যা হচ্ছিল যে, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশীয় সংগীতকে ধরে রাখার কাজে লিপ্ত বা সম্পূর্ণভাবে দেশীয় সংগীতের সাথে জড়িত, তারা ধাক্কাটা খেয়েছিলেন প্রথমে। তাদের জন্য জিনিসটা গ্রহণ করা শুরুর দিকে সহজ হয়নি।’

অনেকে প্রশ্ন রাখতেন যে, এটা কোন ধরনের মিউজিক? শাফিন বলেন, ‘পুরো জিনিসটার সাথে অনেকে অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে কি, দেখেন এতদিন পরে এসে এখন কিন্তু ওই ব্যান্ডসংগীত দেশে যত ধারার সংগীত হচ্ছে, তার সবচেয়ে অগ্রগামী, সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ব্যান্ড মিউজিক। জনপ্রিয়তা কিংবা বাণিজ্যিক দিক থেকে বলেন, সবদিক থেকে, কর্পোরেট সাপোর্ট বলেন, সবদিক থেকে। তার কারণ হচ্ছে আমরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি।’