বর্ষাকালে চোখ বেশি লাল হয় কেন, করণীয় কী?

অদ্বৈত মারুত
২১ জুলাই ২০২৫, ১৫:২২
শেয়ার :
বর্ষাকালে চোখ বেশি লাল হয় কেন, করণীয় কী?

এখন বর্ষাকাল। বাড়ছে নানা ধরনের রোগ-বালাই, বিশেষ করে চোখে। চোখ আমাদের অনেক মূল্যবান সম্পদ। তাই যে কোনো রোগ থেকে আমাদের চোখকে সুরক্ষিত রাখা জরুরি। বর্ষাকালে চোখের রোগ এবং এ থেকে মুক্তির উপায় কী, জানাচ্ছেন মার্কস মেডিকেল কলেজ, মিরপুর-১৪. ঢাকার অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মো. ছায়েদুল হক। আলাপচারিতায় ছিলেন আমাদের সময়ের যাপিত সময়ের বিভাগীয় সম্পাদক অদ্বৈত মারুত

আমাদের সময় : বর্ষাকালে কনজাংকটিভাইটিস বা চোখ লাল হওয়া কেন বেশি দেখা যায়?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : বর্ষাকালে কনজাংটিভাইটিসের প্রাদূর্ভাব বেড়ে যায়। এর পিছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ বা ঝুকিপূর্ণ আবস্থার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তারমধ্যে একটি হলো বাতাসের আর্দ্রতা তখন বেশি থাকে। ফলে চোখের যে পানি বা টিয়ার থাকে তার উপর এক ধরণের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যাতে চোখের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আবার বৃষ্টির ফলে যেখানে সেখানে জলাশয়গুলোতে পানি জমে থাকে। ছেলেমেয়েরা খেলার ছলে অথবা বয়স্করা মাছ শিকারের জন্য এসব জলাশয়ে নামে। অধিকাংশ জলাশয়গুলোতে দূষিত পানির ছড়াছড়ি। এখান থেকে খুব সহজেই চোখে সংক্রমণ দেখা দেয়। এই সময়ের বেশিরভাগ সংক্রমণ ছোঁয়াচে ধরণের হয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ভাইরাল সংক্রমণগুলো বেশি ছোঁয়াচে। এই সময়টিতে চারিদেকে স্যাতস্যাতে পরিবেশে ফাংগাসের জন্য খুবই উপযোগী। ফলে এই সময়টিতে ফাংগাল কনজাংটিভাইটিসের প্রকোপও বেড়ে যায়।

আমাদের সময় : চোখে অস্বস্তি বা চুলকানি হলে নিজে ওষুধ ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া কেন জরুরি?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : সাধারণ চোখ উঠায় চোখে প্রচুর পিচুটি জমে যেটি এলার্জিক কনজাংটিভাইটিসে তেমন একটা থাকে না। আবার এলার্জিক কনজাংটিভাইটিসে প্রচুর চোখ চুলকানি থাকে যেটি সাধারণ চোখ উঠায় কম থাকে। সাধারণ চোখ উঠা বা কনজাংটিভাইটিসে এন্টিবায়োটিক ড্রপ বেশ ফলপ্রসু। তবে এলার্জিক কনজাংটিভাইটিসে স্টেরয়েড জাতীয় ড্রপ বা ওলোপেটাডিন জাতীয় ড্রপ দিতে হয়। স্টেরয়েড জাতীয় ড্রপ সাধারণ চোখ উঠায় ব্যবহার করলে উল্টো ফল হবে। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে চোখে স্টেরয়েড জাতীয় ড্রপ ব্যবহারে চোখের প্রেসার বেড়ে অন্ধত্ব সৃষ্টিকারী গ্লোকুমার মত জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ফলে নিজ থেকে স্টেরয়েড জাতীয় ড্রপ ব্যবহার না করাই উত্তম। এক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উত্তম।

আমাদের সময় : ভেজা তোয়ালে বা অন্যের রুমাল দিয়ে চোখ মুছলে কী ধরনের ঝুঁকি হতে পারে?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : একজনের গামছা রোমাল ইত্যাদি অন্যের ব্যবহার না করাই উত্তম। বিশেষ করে চোখে সংক্রমণ বা চোখ উঠার সমস্যা থাকলে একজনের ব্যবহৃত কাপড়চোপড় বিশেষ করে গামছা বা টাওয়াল ইত্যাদি অন্য কেউ ব্যবহার করলে তারও চোখ উঠার সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।

আমাদের সময় : চোখে সংক্রমণ ছড়ানো রোধে কীভাবে সঠিক ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যায়?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : চোখে পিচুটি জমলে হালকা নরম পরিস্কার কোন কাপড় দিয়ে এবং পানি ঝাপটা দিয়ে চোখ পরিস্কার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে হালকা সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোন মতেই চোখ রগড়ানো যাবে না। কালো চশমা রোদে বা আলোতে কিছুটা স্বস্তিদায়ক। চোখে কোনোমতেই হাত দেওয়া যাবে না। ব্যবহৃত কাপড়চোপড় আলাদা করে ফেলতে হবে বিশেষ করে গামছা বা টাওয়াল ইত্যাদি। হাত সব সময় সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে। 

আমাদের সময় : চোখের রোগ ছড়ানো রোধে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কোন অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা প্রয়োজন?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : চোখকে নিরাপদ রাখতে অপরিস্কার পানি পরিহার করতে হবে, হাত নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে, বিনা কারণে চোখে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। একজনের গামছা রোমাল ইত্যাদি অন্যের ব্যবহার না করাই উত্তম। বদ্ধ ময়লা পানিতে সাঁতার কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে।

আমাদের সময় : ছোট শিশুরা চোখের অস্বস্তি প্রকাশ করতে না পারলে তাদের চোখের কোন কোন লক্ষণ বোঝা যাবে যে, তার চোখে সমস্যা আছে?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : শিশুরা নিজেদের চোখের সমস্যার কথা বলতে বা বুঝাতে সক্ষম নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে শিশু বারবার চেখে হাত দিচ্ছে কিনা, চোখের কোনায় পিচুটি জমে থাকে কিনা বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠার পর। অনেক শিশু আলোতে থাকাতে অস্বস্থিবোধ করে। আবার অনেক শিশুর চোখে পানি পড়া সমস্যা দেখা দেয়। এগুলো থেকে আঁচ করা যায় শিশুরচোখের সমস্যা আছে। 

মার্কস মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মো. ছায়েদুল হক । ছবি: সংগৃহীত

আমাদের সময় : বর্ষাকালে কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীরা কী ধরনের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করবেন?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : এই সময়টিতে চারিদেকে স্যাতস্যাতে পরিবেশ ফাংগাসের জন্য খুবই উপযোগী। ফলে এই সময়টিতে ফাংগাল কনজাংটিভাইটিসের প্রকোপ বেড়ে যায়। কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারীগণ এই সময়টিতে লেন্সটি প্রতিদিন ব্যবহার করার আগে হাত ভালো করে ধুয়ে নিবেন এবং লেন্সটি ভালো করে পরিস্কার করে তবেই ব্যবহার করবেন। তা না হলে খুব সহজেই প্রথমে কন্টাক্ট লেন্স সংক্রমিত হবে এবং তা থেকে ব্যবহারে চোখে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবে। 

আমাদের সময় : চোখে সংক্রমণের লক্ষণ শুরু হলে স্কুল বা কর্মস্থলে যাওয়া ঠিক হবে কি?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : কোন কোন চোখ উঠা বেশ ছোঁয়াচে বিশেষ করে এডিনো ভাইরাসজনিত চোখ উঠা। এক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। জনসমাগম, অনুষ্ঠান, ক্লাস ইত্যাদি পরিহার করে চলাই ভালো। শিশুরা যেহেতু নিজেদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব একটা যত্ন নিতে সক্ষম নয় তাই এই সময়টিতে ওদেরকে স্কুলে না পাঠানোই উত্তম। কারণ এতে একই সময়ে অনেক শিশু আক্রান্ত হতে পারে। 

 আমাদের সময় : বর্ষাকালে চোখ ভালো রাখতে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উচিত বলে মনে করেন?

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : যেকোন সংক্রমণ প্রতিরোধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি এক ধরণের দেওয়াল তৈরি করে থাকে। চোখের সংক্রমণ বা কনজাংটিভাইটিসের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রয়োজ্য। চোখের সংক্রমণ প্রতিরোধে চোখের পানি বা টিয়ার একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে ভিটামিন এ জাতীয় খাবার যেমন গাজর, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, টমেটো ইত্যাদি, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার যেমন বাদাম ছোলা ইত্যাদি, ওমেগা ৩ যেমন তৈলাক্ত মাছ সহ সামুদ্রিক মাছ ও ডিম বেশ উপকারী। চিনি সমৃদ্ধ খাবার, ঝাল বা ভাজাপোড়া খাবার এবং কারো কারো বেলায় এলার্জি আছে এমন খাবার পরিহার করা উচিৎ। শর্করা জাতীয় খাবারের আধিক্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে খাবার অভ্যাস করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।

আমাদের সময় : আপনাকে ধন্যবাদ।

প্রফেসর ডা. মো. ছায়েদুল হক : আমাদের সময়ের পাঠকদেরও ধন্যবাদ এবং সর্বশেষ কথা হলো, নিজের চোখের যত্ন নিন। আপনি ও আপনার পরিবারকে সুস্থ রাখুন।