প্রত্যাহার ও দুদক আতঙ্ক, আস্থা ফেরেনি এনবিআরে

আবু আলী
২১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
প্রত্যাহার ও দুদক আতঙ্ক, আস্থা ফেরেনি এনবিআরে

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক অবসর, দুদকের তদন্ত, বরখাস্ত, প্রত্যাহার ও বদলি আতঙ্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এখনও আস্থা ফেরেনি। এনবিআর পুনর্গঠনে জারি করা অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মীরা পরে সরকারের কাছে গণক্ষমা চাইলেও রেহাই মিলছে না অনেকের। এতে ভয় নিয়ে কাজে মনোযোগী হতে পারছেন না তারা। ফলে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সংস্কারের পাশাপাশি কর্মীদের বিশ্বাস ও আস্থা বাড়ানো জরুরি। এতে রাজস্ব আদায়ে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জানা গেছে, গত ১২ মে সরকার এনবিআর পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এনবিআর ভেঙে দুটি বিভাগ (রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা) গঠনের জন্য অধ্যাদেশ জারি করে। সেটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকারের পক্ষ থেকে সেটি সংশোধনের আশ্বাস দিলে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। তবে স্বার্থ সংরক্ষণে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান কর্মকর্তারা। ২২ জুন কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলি করে আদেশ জারি করে এনবিআর। তাদের ২৪ জুন বা তার আগে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে বলা হয়। তবে সেই বদলি আদেশ প্রত্যাখ্যান করে ২৪ জুন এনবিআর ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে বদলির আদেশ ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানান কর্মকর্তারা। পরে ২৯ জুন ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় কোনো সাজা দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন তারা। কিন্তু পরে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ও বদলির আদেশপত্র ছেঁড়ার দায়ে ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত, শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে অবসর এবং একাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করে সরকার। এরপর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এদিকে, বর্তমানে এনবিআরের ১৬ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া আরও অনেকের নাম রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আন্দোলনের কারণে প্রাথমিক হিসেবে জুন মাসে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত কমিটি করেছে সরকার। সাধারণ ক্ষমা চেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানান জায়গায় ধরনা দিলেও কাজ হচ্ছে না। গণক্ষমা প্রার্থনা করলেও ছাড় দিচ্ছেন না এনবিআর চেয়ারম্যান। পাশাপাশি বোর্ডে যুক্ত প্রায় সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে বরখাস্ত, বদলি, দুদকের তদন্তের তালিকা। নতুন করে আরও অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা করেছে সরকার। এ নিয়ে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোয়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরও প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের ছবি, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ কার্যক্রম, মোবাইল লোকেশন এবং গোয়েন্দা তথ্য পর্যালোচনা করে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কর বিশেষজ্ঞ এবং এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ডিরেক্টর স্নেহাশীষ বড়ুয়া আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং এর অধীনস্থ দপ্তরসমূহের সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ, বারংবার শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে এক আদেশে বিচার সম্পন্ন, কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রত্যাহার কিংবা নতুন করে আরোপ না করা এবং স্বচ্ছ ও ন্যায্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবার মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন করা। এটি করতে ব্যর্থ হলে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং এর অপরিহার্য কর্মী বাহিনীর মনোবল দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, যা রাজস্ব সংগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বড় প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আহরণে: সদ্য বিদায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা, যা এযাবৎকালের রেকর্ড। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত অর্থবছরে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় না হওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো জুলাই আন্দোলন এবং এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলন। এ ছাড়া এনবিআরে দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া; কর জাল বৃদ্ধি না পাওয়া, কর কর্মকর্তাদের সক্ষমতার অভাব, শুল্ক-কর ফাঁকি, পর্যাপ্ত অটোমেশন না হওয়ার বিষয়ও রয়েছে।

দণ্ডিত কাস্টমস কর্মকর্তাকে পুনর্বহাল ও বিভাগীয় শাস্তি: দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার ও কারাবাসের পর বরখাস্ত হওয়া চট্টগ্রামের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করেছে এনবিআর। তবে তার বিরুদ্ধে ‘বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ’ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, দেলোয়ার হোসেন (দুদক) কর্তৃক দায়ের করা একটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে ১ মাস ১০ দিন কারাভোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক সার্ভেন্টস (ডিসমিশাল অন কনভিকশন) অধ্যাদেশ ১৯৮৫-এর বিধি অনুযায়ী তাকে ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত এবং একই বিধিমালার আওতায় ৯ মে পূর্ণ বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করেন এবং আদালত ২০২১ সালের ১৪ মার্চে দেওয়া রায়ে তার কারাদ- বাতিল করে ৫ লাখ টাকা অর্থদ- প্রদান করেন, যা তিনি পরিশোধ করেন। আদালতের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪২(২) ধারা অনুযায়ী তাকে পুনর্বহাল করে বিভাগীয় দ- হিসেবে ২৯ জানুয়ারি ২০১২ হতে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত সময়কালের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

২০১০ সালের ২৯ মার্চ দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদিন শিবলী কাস্টমস কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে নোটিশ দেন। দেলোয়ার হোসেন সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলায় দেলোয়ার ছাড়াও তার স্ত্রী ও ছেলেকে আসামি করা হয়েছিল। এ মামলার পর দুদকের আইনি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করেছিলেন দেলোয়ার।