কমপ্লিট শাটডাউনে দ্বিতীয় দিন নিহত ৬৭, কারফিউ জারি
গত বছরের ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে দ্বিতীয় দিনের মতো ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালিত হয়। এই কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, গুলি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এতে সারাদেশে অন্তত ৬৭ জন নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শেখ হাসিনা সরকার সারাদেশে কারফিউ জারি করে। এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান তাদের অভিভাবকরাও। ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক’ শীর্ষক ব্যানারে রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করে সর্বস্তরের অভিভাবক সমাজ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রবাসীদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে বাংলাদেশে খুনি শেখ হাসিনা সরকার আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর ক্র্যাকডাউন চালানো শুরু করেছে। অর্ধশতাধিক মানুষকে হত্যা এবং দশ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করেছে। প্রবাসী বাংলাদেশি সব ভাই-বোনের প্রতি আহ্বান, আপনারা যে দেশে রয়েছেন, সেই দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে বাংলাদেশে বিরাজমান ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা তুলে ধরুন।’
এদিকে ১৯ জুলাই শিক্ষার্থী ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে দিনভর ব্যাপক সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতর থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় ঐক্য সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ও টিয়ার শেলে কর্মসূচি প- হলে নেতাকর্মীরা বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে শান্তিনগরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্যদিকে নয়াপল্টন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হন। দুপুরে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মিছিল বের করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ভাসানী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলুসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এদিন আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়ে র্যাব।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
সন্ধ্যায় গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন তিনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন শিক্ষার্থীদের হাতে নেই।
এদিন হাসপাতালগুলোতে গুলিবিদ্ধ মানুষের ঢল নামে। আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, বিজিবির ডিজি ও ডিএমপি কমিশনার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করা হয়। মধ্যরাতে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯ জুলাই সকাল থেকেই দ্বিতীয় দিনের মতো কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালনে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। আর আগের দিন থেকেই রাজপথে নামে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা ও মহাখালীতেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ঘিরেও রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষ হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
ঢাকার বাইরে খুলনার শিববাড়ী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, চট্টগ্রাম, রংপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গোলযোগের মধ্যে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
১৯ জুলাই রামপুরা থানা ও রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পূরবী পর্যন্ত পাঁচটি পুলিশবক্সে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। পিবিআই কার্যালয়, বনানীতে বিআরটিএর সদর কার্যালয় ও মিরপুরের মেট্রো-১ কার্যালয়, মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরনো ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিন মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর চালানো হয়। এ জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
এদিন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক অনেক ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল চলাচলও বন্ধ ছিল। এদিন সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব ফের প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখাসহ ৯ দফা দাবি পেশ করে।