ছাদে সৌরবিদ্যুতে বিশেষ জোর

লুৎফর রহমান কাকন
১৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ছাদে সৌরবিদ্যুতে বিশেষ জোর

দীর্ঘদিন ধরেই দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে সরকার। সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সোলার প্যানেল স্থাপন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) স্থাপনের চেষ্টা করছে। তবে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। কাজ এগিয়েছে অনেকটা ধীরগতিতে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎ খাতে নানা সংস্কারের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ¦ালানি খাত দ্রুত সম্প্রসারণ করতে নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুতের সিস্টেম স্থাপন করে ডিসেম্বরের মধ্যে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ বিভাগের এক বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পরিকল্পনায় বাস্তবায়নযোগ্য যেসব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে সেগুলোর কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সারাদেশে রুফটপ সোলার স্থাপনে সরকার-পরিকল্পিত কার্যক্রম দ্রুত বেগবান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের নির্দেশে আমরা এখন নবায়নযোগ্য জ¦ালানি বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করছি। বাতিল হওয়া ৩৭টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুনর্বিবেচনার কাজ করছে পিডিবি। আগের সরকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। বিশেষ করে তরল জ¦ালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ আবার আলাদা আলাদা ছিল। সেগুলো সমন্বয়ের কাজ চলছে। তবে এখন নতুন প্রকল্প হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নে বেশি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে গত ২৬ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ‘জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সব সরকারি ভবন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও সব সরকারি হাসপাতালের ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার ওই নির্দেশনার পর ২৯ জুন উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জাতীয় রুফটপ সোলার কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এরপরই বেশি তৎপর হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

এরই মধ্যে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অর্ধবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এটি বাস্তবায়ন হলে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। উৎপাদিত বিদ্যুতের আর্থিক মূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ইনভার্টার, সোলার প্যানেল, ব্যাটারির ওপর ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে; সোলার রুফটপ বিকাশে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে দুই মেয়াদে অর্ধবার্ষিক দুই ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একটির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অন্যটির আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুতের সিস্টেম স্থাপন করে ডিসেম্বরের মধ্যে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাদে একই সময়ে প্রায় একই পরিমাণ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সব বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা নিজেই অথবা সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো বিনিয়োগ করতে হবে না। এমনকি প্যানেল স্থাপন, বিদ্যমান সংযোগের রেনোভেশন বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বহন করতে হবে না। উপরন্তু এই মডেলের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাদ ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য একটি ভাড়া পাবে, যা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিলে সংযুক্ত হবে।

অন্যদিকে সরকারি অফিসের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য, সিস্টেমের ক্যাপাসিটি ভেদে প্রাক্কলিত মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সব সরকারি অফিস তার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ের কাছে বরাদ্দ চাইবে। মন্ত্রণালয় সারাদেশ থেকে প্রাপ্ত চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সম্মিলিতভাবে বরাদ্দ দেবে। পরে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হবে। ওপেক্স মডেলে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমেও সিস্টেম স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। এ দুই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ৬ মাসের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।

মূলত এই সিস্টেমগুলো নেট মিটারিংয়ের আওতায় আসবে। যার মাধ্যমে গ্রাহকের বিল সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ রুফটপ সোলার থেকে উৎপাদিত গ্রাহকের চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে চলে যাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পাবে গ্রাহক। প্রতি তিন মাসে বিদ্যুৎ গ্রহণ ও সরবরাহ সমন্বয় করে তার বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণ করা হবে।

২০০৮ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পূরণের কথা থাকলেও তা পূরণ হয়নি। পরে একাধিক লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলে তাও অর্জন করতে পারেনি সরকার।

২০২৫ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২০ শতাংশ (আনুমানিক ৪ হাজার ৪৪৪ মেগাওয়াট) এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ (আনুমানিক ৮ হাজার ৮৮৮ মেগাওয়াট) নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এরই মধ্যে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থলভিত্তিক ৫৫টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়ন হতে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান।