দেশে মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে

এহ্সান মাহমুদ
১৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দেশে মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে

আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট দেশের ১৭তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন মো. আসাদুজ্জামান। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আমাদের সময়ের সঙ্গে। আলাপচারিতায় ছিলেন আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক এহ্‌সান মাহমুদ

আমাদের সময় : আপনি গত বছর ডিসেম্বরে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরিত হবে। কিছুদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের রায়ও এসেছে। এখন এ বিষয়ে আপনার কী মতামত?

মো. আসাদুজ্জামান : আমি এ রকম কিছু বলেছিলাম কি না; মনে পড়ছে না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় যে অবৈধ, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য এ রকম সরকারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এতদিন বাংলাদেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলও এর পক্ষে কথা বলে এসেছে। অবশেষে সেই দাবি বাস্তব ভিত্তি পেয়েছে। আরেকটি বিষয়, এটা তো এখনও আপিল বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যে আইনত অবৈধ নয়, সে রায় আমরা পেয়েছি। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কীভাবে পুনর্বহাল হবে- সেটা ভাবনার বিষয়। একটি তথাকথিত নির্বাচিত সরকার যখন তার মন্ত্রিসভা, সংসদের স্পিকার ও সংসদ সদস্যসহ পালিয়ে যায়, তখন রাষ্ট্রপতি তাৎক্ষণিক করণীয় সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের কাছে পরামর্শ চান। সুপ্রিমকোর্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরামর্শ দেন। এভাবে সাংবিধানিকভাবে সঠিক প্রক্রিয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরবে কি না, এটা বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আমাদের সময় : এতদিন শুনেছি, আদালতে এমনকি উচ্চ আদালতেও মামলা জট রয়েছে। বিচারপ্রার্থীরা সঠিক সময়ে বিচার পাচ্ছেন না। ৫ আগস্টের পর বিচার বিভাগে তো বিশাল রদবদল হলো। এখন মামলা জটের কী অবস্থা?

আসাদুজ্জামান : মামলা জট ছিল, আছে, থাকবে। কারণ বিচারকের সংকট রয়েছে। আবার তাদের স্বচ্ছতারও সংকট রয়েছে।

আমাদের সময় : স্বচ্ছতা মেনে তাদের নিয়োগ হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও কিন্তু এসে যায়...

আসাদুজ্জামান : দীর্ঘদিন তো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এখন উচ্চ আদালতে স্বচ্ছতা মেনেই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে কথা বলেছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারক নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা প্রধান বিচারপতিকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচারক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করবেন।

আমাদের সময় : এ কমিটিতে কারা আছেন?

আসাদুজ্জামান : প্রধান বিচারপতি এ কমিটির সভাপতি। তার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হয়েছে।

আমাদের সময় : আইসিটি আদালতে বলা হয়েছিল, সাজা ঘোষণা হলে আসামিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিছুদিন পূর্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত?

আসাদুজ্জামান : স্বাভাবিক আইনে যা বলা আছে, সেটাই। এখানে আলাদা কিছু ভাবার সুযোগ নেই। তবে এ রায়ে তার নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাধাগ্রস্ত হবে না। কারণ, এটি আদালত অবমাননার ছয় মাসের জেল। এ রকম শাস্তিতে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধা নেই। তবে অন্য যে কোনো মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত হলে তিনি আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

আমাদের সময় : সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন এবং হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। এটার সম্ভাবনা কতখানি?

আসাদুজ্জামান : হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণের বিষয়ে জনগণ মতামত দিতেই পারেন। কিন্তু বর্তমান সংবিধানের আলোকে এর সঙ্গে যদি অষ্টম সংশোধনীর রায় পড়া হয়, তাহলে এটার সুযোগ নেই। কারণ, অষ্টম সংশোধনীতে এ প্রক্রিয়াকে অসংবিধানিক বলা হয়েছে। তবে ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আমাদের কাছে এখনও আসেনি। এলে পরে কমিশনের রিপোর্টকে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করতে পারব।

আমাদের সময় : ৫ আগস্টের পূর্বে বিচার বিভাগ দলীয়করণের অভিযোগ আছে। নতুন প্রেক্ষাপটে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বিচার বিভাগ কি এখন স্বাধীন?

আসাদুজ্জামান : এটা নিয়ে জনমনে বিতর্ক আছে। এ বিতর্ক যে পুরোপুরি অযৌক্তিক, তা বলব না। তবে যে স্কেলে বিচার বিভাগকে আগে ব্যবহার করা হয়েছে; কতিপয় মানুষের আবদারের ওপর ভিত্তি করে সন্ধ্যার পর মোমবাতি জ্বেলে রাজনৈতিক নেতাদের রায় রাতারাতি বদলে গিয়েছে, সেই সংস্কৃতি থেকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পেরেছে।

আমাদের সময় : অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপের কথা শোনা যায়।

আসাদুজ্জামান : দেখুন, বাংলাদেশের মানুষ আগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ ফ্যাসিস্টের পক্ষে, আরেক ভাগ ফ্যাসিস্টের বিপক্ষে। আইনজীবীদের মধ্যে যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে অবদান রেখেছেন, তারা যদি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন এবং যথাযথ যোগ্যতা অনুযায়ী পদ আশা করেন, এটাকে আমি বেআইনি মনে করি না। আপনি যদি গুরুত্বপূর্ণ পদে এই লোকদের বসাতে না পারেন, তাহলে পুরো বিচার বিভাগ কিন্তু সেই ফ্যাসিস্টদের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে যাবে।

আমাদের সময় : দেশে মব-সন্ত্রাস বেড়েই চলেছে, এ থেকে উত্তরণে আপনার অভিমত জানতে চাই।

আসাদুজ্জামান : মব জাস্টিস আসলে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা রাষ্ট্রের পক্ষে সবসময় স্বাধীন বিচার বিভাগের সঙ্গে আছি।

আমাদের সময় : আদালত চত্বরে প্রশাসনের বেষ্টনীর মধ্যেও কিছু আসামিকে হেনস্তার শিকার হতে দেখা যাচ্ছে...

আসাদুজ্জামান : এটা সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত। কোনো সভ্য সমাজে এটা প্রত্যাশা করা যায় না। এটা স্পষ্টতই মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আরও সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাই। তবে, এই যে বিপুল জনরোষ, এটাকে আপনি সহজে জাস্টিফাই করতে পারবেন না। যে মানুষগুলোর পরিবার গুম-খুনের শিকার হয়েছে; যেসব মানুষ দীর্ঘ ১৭ বছর নিজ গৃহে ফিরতে পারেননি; যাদের কথা বলার অধিকার ছিল না, ভোটাধিকার ছিল না; অকথ্য নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন- এসব মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করাটাও কিন্তু এত সহজ নয়। এর পরও সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সময় : অনেক রাজনীতিবিদের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। উল্টো দেশে মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

আসাদুজ্জামান : প্রথমেই বলে রাখি এটা একটি মিসলিডিং। অভিযোগ থাকতেই পারে। রাজনীতিবিদদের প্রত্যাশা পূরণে সময় লাগতে পারে। কিন্তু দেশে তো মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সরকার সেটি কঠোর হাতে দমনও করেছে। তাই ঢালাওভাবে মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- এটা যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ নয়।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার ওপর মব হলো, আপনার ভাষায় যেটি মবতন্ত্র। তখন কিন্তু প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে মবকারীদের আইনের আওতায় এনেছে। তার মানে এই না যে, নুরুল হুদার বিচার হবে না। অবশ্যই নুরুল হুদার বিচার হবে। তবে এভাবে কাউকে হেনস্তা করাটা সরকার সমর্থন করে না।

আমাদের সময় : আগামী জাতীয় নির্বাচনে আদালতকে ব্যবহার করে কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ সুগম হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে...

আসাদুজ্জামান : একটি অস্ত্র যদি দেশবিরোধী সন্ত্রাসীদের হাতে থাকে, তাহলে সেটি দিয়ে তারা দেশের ক্ষতি করবে; মানুষ খুন করবে। একই অস্ত্র যদি দেশপ্রেমিক বিপ্লবীর হাতে থাকে, তাহলে ওই বিপ্লবী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, দেশের জনগণের কল্যাণে সেই অস্ত্র ব্যবহার করবে। এখন একই জিনিস, বিভিন্নজনের দৃষ্টিতে ব্যবহার ভিন্নরকম। এই আদালতকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। আবার সেই আদালতই এখন দেশের মানুষের অধিকার রক্ষার ভূমিকায় রাখছেন। দলীয় স্বার্থে এতদিন যারা রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, দলের নিবন্ধন হারিয়েছেন, আমাদের কর্তব্য হলো তাদের সেই অধিকার যথাযথভাবে ফিরিয়ে দেওয়া। এটা তাদের আইনি অধিকার। এখানে পক্ষপাতিত্বের কিছু নেই।

আমাদের সময় : সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট একটি দলের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেক্ষেত্রে তাদের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব?

আসাদুজ্জামান : আগে দেখতে হবে অভিযোগ কতখানি সত্য। অভিযোগ করলেই তো কাউকে দোষী বলা যায় না। এর পেছনে সত্য ভিত্তি লাগে। একজন মানুষ একটি দলকে সমর্থন করতেই পারেন। তবে তাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের সময় অবশ্যই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে।

আমাদের সময় : সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে বিএনপি মামলা করার পর সরকার তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর আগে সরকার কেন তাদের আইনের আওতায় আনল না?

আসাদুজ্জামান : সরকার তার প্রায়োরিটি লিস্ট অনুসারে কাজ করবে। এটা হয়তো সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টের প্রথম দিকে ছিল না।

আমাদের সময় : তাহলে কি আওয়ামী লীগের বিচারের বিষয়টি সরকারের প্রায়োরিটি লিস্টে নেই?

আসাদুজ্জামান : এটা আপেক্ষিক বিষয়। সরকার যা করে, সরকারের মতো করে, জনগণ ভাবতে পারে উল্টোটা। সরকারের সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টার কমতি নেই। বিগত তিন টার্মে ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে নির্বাচনে কারচুপিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাদের প্রত্যেকের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তবে রাজনীতিবিদদের নানা মত-অভিযোগ থাকবেই। তাদের সমালোচনাকেও স্বাগত জানাই। তারা সমালোচনা না করলে তো আমরা ভুল থেকে সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরতে পারব না।

আমাদের সময় : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আসাদুজ্জামান : আমাদের সময়কেও ধন্যবাদ।