কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে অচল দেশ, নিহত ৩১
গত বছরের ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে পুরো দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও বিএনপি ও তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী-সমর্থকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সরাসরি কর্মসূচিতে অংশ নেয়। এর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
আন্দোলনকে সফল করতে এ দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের কঠোর বার্তা দিয়ে বলেন, ‘দলীয় পদে থাকতে হলে, আন্দোলনে অংশ নিতে হবে।’ তার এই বার্তা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা চালায়। তার জবাবে আন্দোলনকারীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
এ দিন সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ২ জন, নরসিংদীতে ২ জন এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রায় দেড় হাজার মানুষ আহত হয়। এর আগে ১৬ জুলাই আন্দোলনে সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা ৩৭ জনে পৌঁছায়।
ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা, আহত করার প্রতিবাদ এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ১৯ জুলাই শুক্রবার বেলা তিনটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় ঐক্য সমাবেশ ও মিছিল এবং একই সময়ে দেশের সব মহনগর ও জেলা সদরে সমাবেশ-মিছিল করার ঘোষণা দেওয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এসব কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে ১৮ জুলাই গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ব্যর্থতা ও খুনের দায়ে সরকারের বিদায়ের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
১৮ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবন এবং মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ডেটা সেন্টার ও সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এ দিন ঢাকাসহ সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এ ছাড়া ডিএমপি অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। রাত ৯টার পর থেকে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৮ জুলাই বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় আগুন দেওয়া হয়। যাত্রাবাড়ী ও কাজলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ রাজধানীর অনেক এলাকার সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে মেট্রোলাইনের নিচে মিরপুর-১০ গোলচত্বরে ফুটওভার ব্রিজে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।
এ দিন উত্তরায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও র্যাবের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দিনভর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। এ ছাড়াও রাজধানীর মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর-১০, নীলক্ষেত, আজিমপুর, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নেন পুলিশের সদস্যরা। বিকালে তাদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়। এ দিন দেশের ৪৭ জেলায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে (তৎকালীন) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি সরকার।’ তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে। পরের দিন ১৯ জুলাই সারাদেশে শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখা এবং জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম।
এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের ২৪ জন নেতাকর্মী দল থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানুষের এ অধিকার নিশ্চিত করা।
এ দিন যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।