নতুন চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি

আবু আলী
১৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
নতুন চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি

চাপ কমছে না দেশের অর্থনীতিতে। নিয়ন্ত্রণে আসেনি প্রধান কয়েকটি সূচক। মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী হলেও পণ্যের দামে নেই স্বস্তি। কর্মসংস্থানে সুখবর নেই। রিজার্ভ বাড়লেও টেকসই অবস্থান নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। রাজস্ব আহরণেও রয়েছে বিশাল ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপ। বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অর্থনীতিতে স্বস্তি না ফিরলে বিপর্যয় হতে পারে।

তারা আরও জানিয়েছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাড়ছে না বিনিয়োগ। আর পুরনো ক্ষত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জুন মাসজুড়ে এনবিআরে আন্দোলনের কারণে ঘাটতি আরও বেড়েছে। রাজস্ব আহরণে এনবিআরকে আধুনিকায়ন এবং সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে গত ১৫ বছর দেশে একটি শ্রেণির কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য আটকে ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শেয়ারবাজারেও নেই সুখবর। অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাবাজারে বিনিয়োগ করে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কাটছে না শনির দশা; আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে দেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা চলছে। বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নিঃস্ব ব্রোকার, ডিলার ও মার্চেন্ট ব্যাংকাররাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থা ভালো নয়। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে- বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স বেড়েছে, কমেছে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে।

জানা গেছে, জামানতের চেয়ে তিনগুণের বেশি ঋণ দেওয়ায় ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ‘লাল’ তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণের ৮৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হয়েছে। তারল্য সংকটে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীরা সময়মতো টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ২০টি প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের প্রায় ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। অন্যদিকে দেশে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতের ৩২টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা উচ্চ ঝুঁকিতে। এতে সময় মতো বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না বীমা কোম্পানি। ফলে বীমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়েছে। এ কারণে পিছিয়ে পড়ছে বীমা খাত।

জানা গেছে, অনাদায়ী ঋণ বেড়ে যাওয়া ও কিছু ব্যাংকের দুর্বল অবস্থায় আর্থিক খাতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কিছু ব্যাংক অবস্থার উন্নতি ঘটালেও অনেক ব্যাংক এখনও দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সুশাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আইনগত আদায় এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা অধিগ্রহণ না করলে আর্থিক খাতের এই দুর্বলতা স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিঘœ ঘটতে পারে। এদিকে সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮) বাজেট বাস্তবায়নে অন্তত সাতটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বলা হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতির পারদ কিছুটা কমলেও তা এখনও চড়া। ফলে নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্ট রয়েছে নিত্যবাজারে। সরকারের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ রপ্তানি খাত। নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশি রপ্তানির ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণায় উদ্বিগ্ন রপ্তানিকারকরা। এতে নতুন অর্থবছরে রপ্তানি খাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে জিডিপির অনুপাতে রাজস্বের নিম্নহার। বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারের সক্ষমতার অভাব দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হিসেবে উচ্চ সুদহারের বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাজারে সুদের হার বাড়ার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করছে। আগামী দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতি না কমলে বেসরকারি বিনিয়োগ গতি হারাতে পারে; স্থবির হয়ে যেতে পারে বিদেশি বিনিয়োগ। এর ফলে বেকারত্ব বাড়বে, প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

কঠোর মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির কারণে বর্তমানে একটি সীমিত ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে উচ্চ নীতিগত হারের কারণে বাজারে সুদের হারও বেড়েছে। আগামী মাসগুলোতে যদি মূল্যস্ফীতি না কমে, তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগের গতি কমে যেতে পারে এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়তে পারে। এতে বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনীতির পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

এদিকে বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে তিন দিনের বৈঠকে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সমঝোতা হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে ১ আগস্টের আগে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে আরও এক দফা আলোচনা হবে। এদিকে শুল্ক চুক্তির ক্ষেত্রে দরকষাকষির প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পাল্টা শুল্ক ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে পারে। এ অবস্থায় দেশ থেকে তৈরি পোশাকের অনেক রপ্তানি ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল হচ্ছে। বিদ্যমান শুল্কের ট্যারিফ ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। এর সঙ্গে ৩৫ শতাংশ যোগ হলে মোট ট্যারিফ দাঁড়ায় ৫১ শতাংশ। এই হারে ব্যবসা চালান অসম্ভব হয়ে যাবে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় শুল্কহার বেশি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ বাড়ছে। তারা বলছেন, শুল্ক পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা না জানা পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা আগে থেকেই বলে আসছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ চারটি- চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কের প্রভাব নির্ভর করছে প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর কী হারে শুল্ক আরোপ হচ্ছে তার ওপর। তথ্য অনুযায়ী, মূল দুই প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্কহার অনেক বেশি। ১ আগস্ট থেকে ওই হার কার্যকর হলে প্রতিযোগীদের সক্ষমতার তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অবধারিতভাবে অনেক পিছিয়ে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসের আগে-পরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অর্থনৈতিক কর্মকা- ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চ সুদহার ও জ্বালানির উচ্চমূল্য উদ্যোক্তাদের চাপের মধ্যে রেখেছে। ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ অনেকখানি বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পতন থামানো এবং অর্জনগুলোকে সংহত করার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে নীতিসুদ হার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। কর-জিডিপির হার কম। নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে। বিদেশি ঋণের দায়দেনা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। রপ্তানি ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর করলে হবে না। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। রপ্তানির নতুন নতুন বাজার বের করতে হবে।

অন্যদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে। এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায়। ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। এলডিসি হিসেবে যে কোনো দেশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে।

এদিকে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও অর্থনীতিকে স্বস্তি দিচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। টানা চার বছর পর ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। আমানত বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি কমার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধি। অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোরতা বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এতে রিজার্ভ বাড়ছে, যা অর্থনীতির জন্য সুখবর। তবে এই অবস্থান ধরে রাখা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে।