এখনও আওয়ামী চক্রের আধিপত্য এনসিটিবিতে

এম এইচ রবিন
১৫ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
এখনও আওয়ামী চক্রের আধিপত্য এনসিটিবিতে

দেশের শিক্ষাখাতের অন্যতম গর্ব ‘বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম’ পরিণত হয়েছে দুর্নীতির অভয়ারণ্যে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় পাঠ্যবই ছাপার কোটি কোটি টাকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে পতিত সরকারের পরিবারের সদস্য এবং তাদের ঘনিষ্ঠজনরা। আসন্ন ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপানোর কার্যক্রমে যে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উন্মোচিত হয়েছে, তা কেবল সরকারের নীতিগত স্বচ্ছতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে নাÑ শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার ও ভবিষ্যতের ওপরও ফেলছে গভীর ছায়া। আগামী বছর যথাসময়ে পাঠ্যবই বিতরণ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।

রাজনৈতিক ছায়ায় এনসিটিবি নিয়ন্ত্রণ : এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ভাই রাব্বানি জব্বার এবং গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কাউসার-উজ-জামান রুবেল। দুজনই বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির শীর্ষপদে ছিলেন। নানা কৌশলে তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অধিকাংশ কাজ পাইয়ে দিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, শতাধিক প্রেসের অংশগ্রহণ থাকলেও মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানই পুরো কাজের ৩৫ শতাংশ দখলে রেখেছে।

টেন্ডারে বৈষম্য : একটি নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, অষ্টম শ্রেণির বই ছাপার কাজ প্রায় সোয়া ২০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে আওয়ামী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত কাউসার-উজ-জামান রুবেলের অগ্রণী ও কর্ণফুলী প্রেস পেয়েছে ৩০ কোটি ৩৪ লাখ ৯১ হাজার ২৩১ টাকার কাজ। রাব্বানি জব্বারের আনন্দ প্রিন্টার্স পেয়েছে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ১৬৭ টাকার কাজ। এ ছাড়া দুলাল সরকারের মালিকানাধীন সরকার প্রেস, অন্যন্যা প্রিন্টার্স ও বলাকা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স পেয়েছে ২১ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ৩০২ টাকার কাজ। এসএম মহসীনের প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স পেয়েছে ১২ কোটি ১৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৫ টাকার কাজ। অন্য প্রেসগুলো গড়ে দুই কোটি টাকার বেশি কাজ পায়নি।

একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ : বঞ্চিত প্রেস মালিকদের অভিযোগ, রাব্বানি ও রুবেল মুদ্রণ সমিতিকে ব্যক্তিগত দপ্তরে রূপান্তর করেছেন। নিয়মিত নির্বাচন না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে, ঘনিষ্ঠদের মালিকানাধীন বা আত্মীয়স্বজনের প্রেসে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব সক্ষমতা না থাকা প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে, যার ফলে নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এনসিটিবির দায়িত্বহীনতা : জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সচিব মো. সাহতাব উদ্দিন জানান, ‘এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’ যদিও বাস্তবে বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্রয় প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। এই বক্তব্যে বোঝা যায়, অনিয়ম আড়াল করতেই দায় এড়ানো হচ্ছে।

মুদ্রণ সমিতিতে প্রশাসক নিয়োগ ও দুর্নীতির অনুসন্ধান : অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে বঞ্চিতদের চাপ ও অভিযোগের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রবিবার মুদ্রণ শিল্প সমিতির কমিটি ভেঙে একজন উপসচিবকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে এবং এনসিটিবিকে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার-সংক্রান্ত রেকর্ড চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

বই ছাপানোর দুর্নীতিতে শিক্ষার্থীরাই চরম ক্ষতির শিকার বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, এই সিন্ডিকেটের বলি হচ্ছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী। সময়মতো বই না ছাপা গেলে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে। তদুপরি নিম্নমানের কাগজ ও ছাপার অভিযোগও বেড়ে চলেছে।

অনিয়ম রোধে করণীয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, এনসিটিবি টেন্ডারের শর্তাবলি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে ছোট ও মাঝারি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যায়। এতে একটি গোষ্ঠী বারবার সুবিধাভোগী হয়ে উঠছে। যেসব প্রতিষ্ঠান অতীতে অনিয়মে জড়িত ছিল, সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং পরের বছরগুলোতে তারা আরও বেপরোয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু দুদকের অনুসন্ধান যথেষ্ট নয়। এনসিটিবির টেন্ডার প্রক্রিয়া, মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তিÑ এ তিনটি ক্ষেত্রে সমন্বিত ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। তা না হলে ‘বিনামূল্যে বই বিতরণ’ প্রকল্পটি মহাদুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।