বিদেশি উৎসের ঋণে আবার উল্লম্ফন

জিয়াদুল ইসলাম
১৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বিদেশি উৎসের ঋণে আবার উল্লম্ফন

বৈদেশিক উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ আবার বাড়ছে। সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বিদেশি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন বা ১০২ কোটি ডলার। আগের তিন মাসে ৭০ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ কমেছিল। সবমিলিয়ে গত মার্চ শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে প্রায় ১০৫ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই ঋণের প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলারই বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বাড়ে। অর্থাৎ, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার সরকার বিদেশি উৎস থেকে দেদার ঋণ করে গেছে। এ সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব খাতেই বিদেশি ঋণ বাড়ে। আগামী জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের স্থিতি আরও বাড়বে। কারণ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে গত কয়েক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও এখন কম সুদের বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশে দীর্ঘদিন ধরেই ডলারের সংকট চলছে। এই সংকট সামাল দিতে বিদায়ী সরকারের আমলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি ঋণ বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তারপরও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রিজার্ভের পতন থামাতে সক্ষম হয়। ডলারের বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতিশীলতা। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিস্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আসায় এখন বিদেশি ঋণ গ্রহণের ঝুঁকি কমে এসেছে। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো- ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে পরিশোধের ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের ঋণই বেশি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ দরকার আছে। তবে উদ্বেগের জায়গা হলো, আগে বিদেশি ঋণ নিয়ে অপচয় হয়েছে। সেগুলো যদি বন্ধ না হয়, তাহলে ঋণ বৃথা হয়ে যায়। আর যদি ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ব্যবহার করা যায়, তাহলে পরিশোধ করার সক্ষমতা তৈরি হবে। তিনি আরও বলেন, জিডিপি অনুপাতে বিদেশি ঋণ এখনও সহনীয় মাত্রায় আছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের অঙ্কটা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ঠিকই ঘাম বেড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৭৬ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ১০৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। তিন মাস আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ১০৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।

তথ্য পর্যালোচানায় দেখা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেওয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া ২ বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তা বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২০১৩ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ওই ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন বাড়লেও ২০১০ সালে তা প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ৭২৯ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ সালে বাড়ে প্রায় ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ও ২০১৩ সালে প্রায় ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এর পরের ৫ বছরে (২০১৪-২০১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই ৫ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ফলে ২০১৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণস্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।

তথ্য পর্যালোচনা আরও দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের ৫ বছরে (২০১৯-২০২৩) বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

২০২২ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ও ২০২৩ সালে বেড়েছে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। এ ছাড়া চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণ বাড়ে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। সবমিলিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ বেড়ে হয় ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।