বীমা খাতে আসছে বড় পরিবর্তন

আবু আলী
১৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বীমা খাতে আসছে বড় পরিবর্তন

দেশে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতের ৩২টি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা উচ্চ ঝুঁকিতে। কোম্পানিগুলো সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ করতে পারছে না। এ অবস্থায় বীমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বেড়েছে। এ কারণে পিছিয়ে পড়ছে বীমা খাত। অন্যদিকে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতায় গ্রাহকের টাকা-পয়সা নিয়ে অনেকে পালিয়ে গেছেন। দীর্ঘদিন ঘুরেও বীমার টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক।

আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে একাধিক কোম্পানি গ্রাহকের জমা করা অর্থ তথাকথিত বিনিয়োগের নামে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে লাখ লাখ গ্রাহক তার দাবির টাকা পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বীমা খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বলেন, বর্তমানে লাইফ বীমার ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ এবং নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে প্রায় ৪৭ শতাংশ বীমা দাবি অপরিশোধিত রয়েছে। এসব দাবি সময়মতো পরিশোধ এবং মানুষের আস্থা বাড়াতে বিভিন্ন আইন ও বিধি যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংক রেজল্যুশনের আদলে বীমাকারীর রেজল্যুশন অধ্যাদেশ প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এর আলোকে কেবল বীমা প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে তেমন নয়; অবসায়ন, অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হবে।

চেয়ারম্যান বলেন, বীমা খাতে স্বচ্ছতা ও আস্থার সংকট নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে আইডিআরএ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমরা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারিনি। আইন থাকলেও প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশেরও প্রয়োজন। বিগত ১৫ বছরে আইডিআরএ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এ অবস্থায় আইডিআরএকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

দেশে ১৩ লাখ গ্রাহকের ৪ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা বীমা দাবি পরিশোধের অপেক্ষায় রয়েছে। পলিসির দাবি পরিশোধ বাকি আছে জীবন বীমা কোম্পানিতে ৪৫ শতাংশ এবং সাধারণ বীমা কোম্পানিতে ৪৬ শতাংশ।

দেশের মোট ৮২টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা মিলিয়ে ৩২টি প্রতিষ্ঠান উচ্চপর্যায়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে মধ্যম পর্যায়ের ঝুঁকিতে। আস্থা হারানোর কারণে বীমা খাতে ১৪ বছরে ৫৪ লাখ গ্রাহক কমেছে। বর্তমানে চালু থাকা পলিসি ৭১ লাখ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বীমা খাতের অবদান কমছে বছর বছর। ২০১০ সালে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ। অথচ ২০২৩ সালে তা কমে দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৪ সালে তা আরও কমেছে।

বীমা কোম্পানিগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে ‘বীমা আইন ২০১০’-এ বড় ধরনের সংশোধনী আনা হচ্ছে। এ সংশোধনের মূল লক্ষ্য হলো- বীমা কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, পারিবারিক প্রভাব কমানো এবং অনিয়ম রোধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা। ১৫ বছর পুরনো আইনটিকে আধুনিক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অর্থাৎ আইডিআরএ আরও শক্তিশালী করাই এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য। এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে বীমা খাতের ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানো হবে, যা বর্তমান আইনে সম্ভব নয়।

নতুন আইনে যদি কোনো বীমা কোম্পানি গ্রাহকের স্বার্থের ক্ষতি করে, তা হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারবে। এমনকি পর্ষদ ভেঙে দুই বছরের মধ্যে নতুন পর্ষদ গঠন করতে হবে। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা পরিবার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো বীমা কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। এর মাধ্যমে পারিবারিক প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা কোম্পানির অফিসে প্রবেশ করে তল্লাশি চালাতে পারবে, প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ এবং পুলিশের সহায়তা নিতে পারবে। এমনকি গ্রাহকের দাবি পরিশোধের জন্য কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রি করার ক্ষমতাও দেওয়া হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে।

কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে না পারে, তা হলে নতুন পলিসি বিক্রি বা প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হতে পারে।

পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বীমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এ ছাড়া পরিচালক বা চেয়ারম্যান হতে হলে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পরিচালকের টানা মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, আস্থাহীনতায় ভুগছে দেশের বীমাশিল্প। জালিয়াতির ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বীমা। আইনের সংস্কার খুবই প্রয়োজন। অনেক আগেই এসব করা দরকার ছিল। আইনের সংশোধনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বাাড়নোর পরামর্শ দেন তিনি।

মতামত প্রদানে ৩ মাস সময় চেয়েছে বিআইএ

অন্যদিকে বীমা আইন, ২০১০-এর সংশোধিত খসড়া প্রস্তাবনার ওপর বিস্তারিত মতামত দিতে আরও তিন মাস সময় চেয়েছে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। ইতোমধ্যে আইডিআরএর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সময় বৃদ্ধির এই অনুরোধ জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, সংশোধিত বীমা আইনের খসড়ার ওপর মতামত দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল ৮ জুলাই পর্যন্ত। তবে মাত্র ১৫ কর্মদিবসের এই সময়সীমায় প্রস্তাবনাটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় আরও সময় প্রয়োজন।