আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শুরু হয়েছে চিরুনি অভিযান

শাহজাহান আকন্দ শুভ
১৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শুরু হয়েছে চিরুনি অভিযান

‘মব’ সৃষ্টি করে একের পর এক নৈরাজ্য এবং নৃশংস হত্যাকা-ের জেরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানীসহ সারাদেশে শুরু হয়েছে ‘চিরুনি অভিযান’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ অভিযানের প্রধান টার্গেট চিহ্নিত চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী, মব সৃষ্টিকারী, ছিনতাইকারী, ডাকাত, দখলবাজ ও মাদক কারবারি। গতকাল রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী চিরুনি অভিযান শুরুর সিদ্ধান্তের কথা জানান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু করেছিল সরকার। ওই অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার।

এদিকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা আরও দুই মাসের জন্য বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল রবিবার এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা কোস্টগার্ড ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) প্রেষণে কর্মরত, তারাও এ ক্ষমতার আওতায় থাকবেন।

গত বুধবার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভাঙাড়ি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯)। পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরো দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। গত শুক্রবার খুলনায় নিজ বাসার সামনে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে গুলি করে এবং দুই পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া একই দিন চাঁদপুরে জুমার নামাজ শেষে মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে জখম করা হয় মাওলানা নূর রহমান মাদানী নামে ওই মসজিদের খতিবকে। এ তিন কা-ের মধ্যে সর্বাধিক আলোচনায় আসে মিটফোর্ডের খুন। বিভিন্ন মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রবিবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা হয়। সভায় দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ সময় র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কীভাবে আরও সক্রিয় করা যায়, এর নানা উপায় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। রবিবার (গতকাল) থেকেই সারাদেশে চিরুনি অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভায়। এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের। এ ছাড়া সভায় অপরাধ দমনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলা হয়।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার যে কোনো সময় চিহ্নিত অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ বা চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে পারে। চিরুনি অভিযান কখন থেকে শুরু হতে পারে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এখন থেকেই। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।

উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি; ‘মব’ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজ, দখলবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ; ‘অস্থিরতা সৃষ্টিকরী’দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া; নারী শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা; মাদকের অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, কারখানাগুলোতে অস্থিরতা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়ের বিষয়েও আলোচনা হওয়ার কথা জানান তিনি।

মিটফোর্ডে সোহাগের মাথা থেঁতলে হত্যার ঘটনা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, এটা অনেক দুঃখজনক ঘটনা, সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। এটা সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখছে। যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, অপরাধী অপরাধীই। সে যে দলেরই হোক না কেন, ছাড় দেওয়া হবে না। সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক স্খলনের কারণেই সমাজে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের সবাইকে এ বিষয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানান।

নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমাদের প্রস্তুতি আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চাই।

‘মব’ সৃষ্টি করে নৃশংসতার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। মিটফোর্ড খুনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কেউ যে পাশে আনসার বাহিনীকে ডেকে নিয়ে আসবে, সেটাও করেনি। তবে এ ক্ষেত্রে কাউকে দোষ দিচ্ছি না।

চিরুনি অভিযান সম্পর্কে গতকাল রাতে পুলিশপ্রধান বাহারুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের অভিযান চলমান আছে। আমরা যে কোনো অপরাধীকেই আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। চাঁদাবাজি যেহেতু মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, তাই আমরা চাঁদাবাজ গ্রেপ্তারে চিরুনি অভিযানে বিশেষ গুরুত্ব দেব। এ ছাড়া মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করা হয়। এতে ২০ শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের মধ্যে আবুল কাশেম নামের একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনার পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গাজীপুরসহ সারাদেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১ মার্চ পর্যন্ত এই অভিযানে প্রায় ১২ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে সারাদেশে মোট গ্রেপ্তার করা হয় ৩০ হাজার ৭২৩ জনকে। তবে ১ মার্চের পর অপারেশন ডেভিল হান্ট কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে এ অভিযান নিয়ে আর কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে পাওয়া যায়নি।

অপারেশন ডেভিল হান্টে ঢাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এবার চিরুনি অভিযানে কোন কোন মহানগর, শহর উপশহর জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোয় চিরুনি অভিযানে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানান পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বৃদ্ধি

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা আরও দুই মাসের জন্য বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে এমন সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এ মেয়াদ বৃদ্ধি কার্যকর হবে আগামীকাল ১৫ জুলাই থেকে এবং তা কার্যকর থাকবে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫(২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অধীন অপরাধগুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা। এ ক্ষমতার আওতায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ-বিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধির নির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

নির্বাচনী সময় ও বিশেষ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের এ ধরনের বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে থাকে সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিশ্চিত করতেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। দেশে উদ্ভূত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরপর থেকে এ মেয়াদ দুই মাস করে বাড়াচ্ছে সরকার।