শুল্কের চাপে পোশাক খাত, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

আব্দুল্লাহ কাফি
১৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শুল্কের চাপে পোশাক খাত, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতির চাপে পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এ খাত থেকে। সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশের পোশাক খাত; রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে ২ এপ্রিল ট্রাম্প ঘোষিত শুল্কনীতি পরবর্তী তিন মাসের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি, ব্যাংকিং খাত, কর্মসংস্থান, রেমিট্যান্স, আমদানি সক্ষমতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমনকি সামগ্রিক অর্থনীতি কঠিন সংকটে পড়বে। এ জন্য তারা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কারোপ হলে বড় আঘাত আসবে তৈরি পোশাক খাতে। বড় শিল্প আঘাত সামাল দিতে পারলেও ছোট-মাঝারি কারখানাগুলো বড় বিপদে পড়বে। এমনকি অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও অপ্রচলিত নতুন নতুন বাজারে বেশি নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

এদিকে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্ক ঘোষণার পর থেকেই কমে আসছে অর্ডার। এমনকি বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো অর্ডার স্থগিত করছে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বলছে, পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। বিশ্বখ্যাত রিটেইল ব্র্যান্ড ওয়ালমার্ট, লিভাইস, এইচঅ্যান্ডএম, জারার মতো ক্রেতারা ইতোমধ্যে অর্ডার স্থগিত করেছে এবং অপেক্ষা করতে বলছে। কেউ কেউ একতরফাভাবে দর কমাতে চাপ দিচ্ছে।

প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেন জানান, ওয়ালমার্টের জন্য ১০ লাখ পিস সাঁতারের পোশাকের অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে।

ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের ফারুক সৈকত এক ই-মেইলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কারোপের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বসন্ত মৌসুমের সব অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে।

প্যাসিফিক সোয়েটার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদ বলেন, আমাদের কারখানায় ৬০ হাজার টি-শার্টের কাজ চলছিল। অর্ডারদাতা প্রতিষ্ঠান হঠাৎ ই-মেইলে কাজ স্থগিত করতে বলেন। এতে মাঝপথে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি, যা বিশাল আর্থিক ক্ষতির কারণ।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, পাইপলাইনে থাকা পণ্যের মূল্য আনুমানিক ২০০ কোটি ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্যমতে, গেল তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ক্রমেই কমছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯১ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, মে মাসে ৮০১ দশমিক ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জুন মাসে ৫১৪ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ

সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতে ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি। আগের বছর এ খাতের মোট রপ্তানি আয় ছিল ৩৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। ইপিবি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তথ্যানুযায়ী, রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বাজার। নতুন বাজারগুলোতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি বেড়েছে। সমাপ্ত অর্থবছরে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে মোট ১৯ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে মোট পোশাক রপ্তানি মূল্যের ৫০ দশমিক ১০ শতাংশ। এ বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। ইউরোপের বড় বাজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে জার্মানিতে, ৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়ে ৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা মোট রপ্তানির ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। কানাডায় প্রবৃদ্ধির হার ১২ শতাংশেরও বেশি। তবে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি কিছুটা ধীরগতি ছিল। গেল অর্থবছরে মাত্র ৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজারেও অগ্রগতি আছে। পোশাকের নতুন বাজারে মোট ৬ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।

তবে রাশিয়া, ইউএই, মালয়েশিয়ার মতো অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি কমেছে। নতুন বাজারে আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নতুন বাজারে প্রবেশ এবং ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ওপর।

অন্তর্বর্তী বাণিজ্য চুক্তি করতে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। ইকোনমিক টাইমসের সংবাদে বলা হয়েছে, এই চুক্তির আওতায় ভারতের পণ্যে শুল্কের হার ২০ শতাংশের নিচে নামতে পারে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সুবিধাজনক জায়গায় চলে যাবে ভারত।

আলোচনা এমন পর্যায়ে আছে, যেখানে ভারত আশা করছে, গত সপ্তাহে ট্রাম্প যেভাবে ২২টি দেশকে চিঠি পাঠিয়ে শুল্কের হার জানিয়েছেন এবং ট্রুথ সোশ্যালে তা প্রকাশ করেছেন, ভারতের বেলায় তা হবে না। ভারত আশা করছে, বিবৃতির মাধ্যমে বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।

তবে ভারত, পাকিস্তানসহ বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো সুবিধা পেলে বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন বিশ^ব্যাংক ঢাকা আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিজিএমএইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক। তিনি বলেন, নতুন বাজারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্টের বাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বাজারে মোট পোশাকের ২০ শতাংশের বেশি রপ্তানি হয়।

এদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ক্রেতারা আমাদের ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’র মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারা আমাদের অপেক্ষা করতে বলছে। এমনকি তারা পণ্যের দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করছে। এটা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর।