ভাইরাল চিন্তা যখন মাথায় ঢুকে যায় সেখানে আর শিল্প থাকে না

তারেক আনন্দ
০৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভাইরাল চিন্তা যখন মাথায় ঢুকে যায় সেখানে আর শিল্প থাকে না

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী। সম্প্রতি তিন মাসের মতো লন্ডন ও আমেরিকায় ছিলেন। শো করেছেন চারটি। একটি ছিল তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও একক সন্ধ্যা। বিদেশের মাটিতেও ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হন। দেশে ফেরার পর কথা হয় গুণী এই শিল্পীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তারেক আনন্দ

তিন মাস পর দেশে ফিরলেন। লন্ডন, আমেরিকায় ব্যস্ততা কেমন ছিল?

লন্ডনে বেশিদিন থাকিনি। মেয়ে আনমলের ওখানে ছিলাম সতেরো দিন। লন্ডনে একটি শো ছিল। আর তিনটি শো করেছি আমেরিকায়।

প্রবাসী দর্শকের ভালোবাসা কতটা উপভোগ করলেন, কেমন উচ্ছ্বাস ছিল দর্শকের মাঝে?

এ বছর মেলায় প্রকাশিত আমার বই ‘ফাহমিদা নবীর ডায়েরী’র মোড়ক উন্মোচন হয়েছে নিউইয়র্কে। সেই সঙ্গে একক সংগীতসন্ধ্যা ছিল। সাধারণত ছুটির দিনে ওখানে দর্শক বেশি হয়। কিন্তু আমার প্রোগাম ছিল অন্য দিন। অবাক করা বিষয়, হলভর্তি মানুষ ছিল আমার প্রোগামে। মোড়ক উন্মোচন শেষে গান গাইলাম ২২টি। সবচেয়ে মজার ছিল, সবাই শাড়ি পরে এসেছে। আমি যেমন খোঁপায় ফুল দিই, ওরাও ফুল দিয়ে এসেছে। তখন মা দিবস ছিল, কয়েকজন মাকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলাম। খুব সুন্দর, গুছিয়ে অনুষ্ঠানটি হয়েছে। ১১টা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও দর্শকরা উঠতেই চান না। তাদের অনুরোধে ১২টা পর্যন্ত গাইতে হয়েছে। আমার একটু শঙ্কা ছিল, নিউইয়র্কের মতো জায়গা। লোকজন আসে কিনা গান শুনতে। একজন বলেছিল, আপা একটা হিন্দি গান করবেন নাকি? আমি ভদ্রভাবেই বললাম, আমি তো হিন্দি গান গাই না, হিন্দি গান গাওয়ার মতো অনেক শিল্পী আছে। তখন হলভর্তি দর্শক আমার এ কথা শোনার পর তালি দিয়েছে।

দেশের বাইরে একক সন্ধ্যা হয়, দেশে আপনাকে নিয়ে একক সন্ধ্যার আয়োজন চোখে পড়ে না কেন?

দেশে আমার সেই সম্মানটা নেই, হয়তো কেউ ভাবে না। ওই চলটা উঠেই গেছে। আগে একক সন্ধ্যা হতো। তখন করার মানুষ ছিল। আগে মানুষ নিজের স্বার্থ এত ভাবত না। সার্বিক দিকটা দেখত। যে একটা একক সন্ধ্যা হবে, সুন্দর, সুন্দর গান শুনব। মানুষ মানুষকে সম্মান দিত। একজন শিল্পীর যথার্থ সম্মান ছিল, এখন সেটা নেই। সবাই ভাইরাল হতে চায়। নিজেকে কীভাবে, কোন উপায়ে প্রমোট করবে সেই ধান্ধা থাকে। যারা এই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত, তারাও কিন্তু খুব প্রেসারে থাকে। তাদের মাঝেও স্বস্তি নেই। ভাইরাল না হলে কিন্তু একজন প্রডিউসার তার গান আর নেবে না। তা হলে প্রতিভাটা কোথায় থাকল? ভাইরাল চিন্তা যখন মাথায় ঢুকে যায়, সেখানে আর শিল্প থাকে না। তখন ওটা প্রডাক্ট হয়ে যায়। মানুষ যখন খারাপ কাজ করতে করতে অভ্যাস হয়ে যায়, তখন ওটাই ভালো লাগে। একটা বাজে ওয়ার্ডের গান জনপ্রিয় হয়ে গেল। সেটা নিয়ে সাময়িক উচ্ছ্বাস থাকে, কিন্তু দুই দিন পর ওই উচ্ছ্বাসের কোনো মূল্য নেই। মৌলিক সুন্দর গানের সংখ্যা খুবই কম হচ্ছে। অনেক গানের সুর ভাঙিয়ে নতুন গান তৈরি হচ্ছে। এভাবে তো আসলে হয় না।

গত কয়েক বছরে এই অস্থিরতা চোখে পড়ছে। আপনার কাছে কী মনে হয়, কেন?

সবাই শুধু ডলারের পেছনে ছুটছে। কীভাবে টিকটক করা যায়, রিলস করা যায়। স্টুডিওতে গিয়ে গানটা মনোযোগ দিয়ে গাওয়ার চেষ্টা না করে ভিডিও বানানোর দিকে মনোযোগ থাকে। গান করা, শিল্পী হওয়া কি এত স্বস্তা? আমি হলফ করে বলতে পারি ক’জন শিল্পী নিয়মিত গানের চর্চা করছে? ক’জন শিল্পী সুন্দর কথা ও সুরের পেছনে ঘুরছে। ভালো কথা লেখার মানুষও আছে, ভালো সুর করার মানুষও আছে। ওই যে দিন শেষে ভিউ হিসাব করে। ভিউটাই মুখ্য। নিজের গানের মান, কয়টা গান ক্যারিয়ারে অর্জন হলো সেটা নিয়ে ভাবছে না। একশ মন্দ গান করার চেয়ে পাঁচটা ভালো গান গেয়ে বেঁচে থাকা যায়। এই বোধটা সবার মাঝে আসতে হবে। এই যে এখন সিনেমা হচ্ছে। অনেক সিনেমার ভিড়ে একটা সিনেমার নাম শুনতে পাচ্ছি ‘উৎসব’। আমরা সবাই মিলে দেখতে যাব। সুস্থ বিনোদন নিতে যাব। জানি না কেমন হয়েছে, তবুও আশা করছি সিনেমাটা ভালো হবে। যিনি নির্মাণ করেছেন, তিনি নাকি খুব কষ্ট করেছেন। তার মানে কি দাঁড়াল? ভালোর দর্শক, শ্রোতা এখনও আছে। সেটা দশ পার্সেন্ট না হোক, দুই পার্সেন্ট হলেও আছে।

এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী বলে মনে করছেন?

যারা ভালো গান গায়, তাদের আরও সিরিয়াস হওয়া উচিত। সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি, সেটার ফল আসবেই। আবার সংগীতসন্ধ্যা হোক। হিংসা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। টেলিভিশনে সুন্দর সুন্দর গান নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। আজকাল গানের যে ট্রেন্ড, সেটা গুটিকয়েক মানুষ নষ্ট করেছে। সম্প্রতি একটা টেলিভিশনে গেলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপা কী করা যায়? আমি বললাম, কী করা যায় না, ভালো গান নিয়ে প্রোগাম করো। এই সময়ে যারা ভালো লিখছেন, তাদের মৌলিক গান নিয়ে অনুষ্ঠান করো। এসব অনুষ্ঠান তো করবে না। কেন করবে না, এগুলো নাকি খায় না, তাহলে কী খায়? ‘দুষ্টু কোকিল’ আর ‘লিচুর বাগান’? আমরা আবার গুহার দিকে চলে যাচ্ছি! সেই আদিম যুগে। মানুষের কোনো কিছু করতে লজ্জা লাগে না। খোলামেলা হয়ে গেছে। রুচিশীলতার আবরণটা ওপেন হয়ে গেছে। কোনো খারাপ কথা বলতে লজ্জা পায় না, খারাপ কাজ করতেও লজ্জা পায় না। প্রত্যেকটা পরিবারকে আলাদা করে ভাবতে হবে। ছেলেমেয়েদের ভালোর সঙ্গে সখ্য গড়ার চিন্তা করতে হবে। যখনই কোনো জিনিস অতিরিক্ত খারাপ হয়ে যায়, তখন ভালো জিনিসের জন্য আবার মানুষ অপেক্ষা করে। আজকেও এক মেয়ে ফোন দিয়েছে, আপা আপনারা দ্ইু বোন আসবেন জেনে আমি যশোর থেকে রওনা দিয়েছি আপনাদের দেখব। আপনাদের জন্য নামাজে বসে দোয়া করি। হাজারটা মন্দের মাঝে এগুলোই তো বেঁচে থাকার প্রেরণা। সবাই যদি একটু সুন্দরের চেষ্টা করি, তা হলে সুন্দর হতে বাধ্য। চেষ্টাটা আমাদের করে যেতে হবে।