ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে গণসংযোগ
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত বছরের ৯ জুলাই সারাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেন। কর্মসূচি শেষে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা। সেখানে ১০ জুলাই সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’-এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচি শুরু হবে। এর পর শাহবাগ মোড়ে গিয়ে সড়ক অবরোধ করবেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে তিনি বলেন, ‘আমরা কোটা বাতিল চাই না। অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ৫-১০ শতাংশ কোটা রেখে বাকি কোটাগুলো রদ করতে হবে।’
৬ জুলাই থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল, মুক্তিযোদ্ধা দলসহ নানা অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠন দলীয় ব্যানার ছাড়া আন্দোলনের মাঠে নামে।
ডান, বাম ও ইসলামপন্থি প্রায় সব রাজনৈতিক দল একযোগে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। জামায়াতে ইসলামি ও ছাত্রশিবিরের সদস্যরাও মাঠে সক্রিয় ছিল।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ৯ জুলাই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি যৌথ সভা করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপর ভর করে সরকার হটাতে চায় বিএনপি- এমন তথ্য জানিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছাত্রলীগকে নির্দেশ দিয়েছিল দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পাশাপাশি সারাদেশের নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। যদিও ৮ জুলাই রাতে তারেক রহমান ভার্চুয়ালি দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে নতুন চার দফা দাবি নির্ধারণ করেন। ৯ জুলাই বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামব।’
৯ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে আরও বলেন, সড়কপথ ও রেলপথ বাংলা ব্লকেডের আওতাভুক্ত থাকবে। ‘বাংলা ব্লকেড’-এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকায়। সকাল ১০টায় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জমায়েত হব। তার পর ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি পালনের জন্য শাহবাগ মোড়ে যাব। শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে এ আন্দোলনে নামেনি জানিয়ে তিনি বলেন, এই ইস্যুতে সরকার নিশ্চুপ থাকার কারণে এ ধরনের কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছে আন্দোলনকারীরা। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস পাই নাই বলেই আমাদের এই আন্দোলন।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ৭ জুলাই থেকে তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন। ৯ জুলাই তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ বন্ধ রেখে ‘গণসংযোগ’ কর্মসূচি পালন করেন। এদিন সমন্বয়করা দেশের বিভিন্ন জায়গার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনলাইনে গণসংযোগ চালান।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
অন্যদিকে, ৯ জুলাই কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। তবে ছাত্রদের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানানো হয়, আপিলকারীরা এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেউ নন।
এদিন কোটা আন্দোলন নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘কোটা ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার নেই, এ ইস্যু এখন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে। রাজপথে আন্দোলন করে এটার নিরসন হবে না।’ একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। এদিন কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে দুপুরে মানববন্ধন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের শহীদ মিনারে ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এই আয়োজন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গণসংযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি ও দুপুর ১২টার দিকে পাঁচটি ছাত্রী আবাসিক হলে গণসংযোগ চালায় তারা। সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
৯ জুলাই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে কলেজ গেটের সামনের সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকালে চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলস্টেশনে রেললাইন অবরোধ করেন। এতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়।
৯ জুলাই বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে একাডেমিক ভবনের সামনে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে স্লোগান দেন তারা। এদিন হবিগঞ্জেও বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা।