দুদকের টার্গেটে এনবিআরের ঘুষ-দুর্নীতি চক্রের হোতারা

তাবারুল হক
০৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
দুদকের টার্গেটে এনবিআরের ঘুষ-দুর্নীতি চক্রের হোতারা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যেসব কর্মকর্তা ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের ধরতে বিশেষ টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এক বছর আগে ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। পরে এ তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার নাম যুক্ত হয়।

সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনে নামার মধ্যে গত এক সপ্তাহে আরও এক ডজন কর্মকর্তার ‘ঘুষ-দুর্নীতি’র তথ্যানুসন্ধানের সিদ্ধান্তের কথা জানায় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।

এদিকে দুদকের এমন তৎপরতার কারণে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে এনবিআরে। প্রতিষ্ঠানটির যারা ঘুষের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাদের অনেকেই দুদকের তালিকায় নিজের নাম আসছে কি না, বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর রাখছেন।

তবে এনবিআরের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবির ইস্যু ঘিরে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধানে নামছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগ নাকচ করে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আইন ও বিধি মোতাবেক যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই শেষে এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুদক কারও হাতিয়ার হয়ে কাজ করে না।’

এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করেনি বলে দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত সোমবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুদকের বিষয়ে আমি কোনো কমেন্ট করব না। দুদকের নিজস্ব টার্মস ও কন্ডিশন আছে। তারা তাদের মতো কাজ করছে। সরকার এতে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।’

দুদকের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘যারা এনবিআরের বিভিন্ন স্টেশনে চাকরি করে ঘুষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে দুদকের একটি শক্তিশালী টিম কাজ করছে। যেসব কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে তার বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এনবিআরের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তাদের নামে ঘুষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে এসব অভিযোগ কতটা সত্য বা মিথ্যা তা যাচাই-বাছাই না করে বলা মুশকিল। যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলছে, প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযোগগুলো নিয়মিত অনুসন্ধানের আওতায় নেওয়া হবে।

৫ দিনে এক ডজন কর্মকর্তার নামে অনুসন্ধান শুরু : সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআরের দুই কমিশনারসহ পাঁচজনের নামে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। তারা হলেন বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, সার্কেল-৭ রাজশাহীর উপকর কমিশনার মো. মামুন মিয়া ও ঢাকা কর অঞ্চল-২-এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ।

এর আগে গত মঙ্গলবার এনবিআরে অন্য পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। তারা হলেন এনবিআর সদস্য লুৎফুল আজীম, ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুর রশীদ মিয়া, কর গোয়েন্দা ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, কর অঞ্চল-১৬-এর উপকর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার তারেক হাসান।

অন্যদিকে গত রবিবার এনবিআরের আরও ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হওয়ার কথা জানায় দুদক। তারা হলেন এনবিআরের অতিরিক্ত কর কমিশনার হাসান তারেক রিকাবদার, সদস্য একেএম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খান, যুগ্ম কমিশনার মোনালিসা শাহরিন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ড। তাদের মধ্যে হাসান তারেক রিকাবদার এনবিআর রিফর্ম অ্যালায়েন্সের সভাপতি।

যা আছে অভিযোগে: দুদকের হাতে আসা অভিযোগে বলা হয়, গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এনবিআরের বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করার সুযোগ নিয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা কর, ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে নিজেরা বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।

এনবিআরের অসাধুচক্র কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে তাদের করের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন বলেও এমন অভিযোগ পেয়েছে দুদক।

অভিযোগে আরও বলা হয়, কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর সরকার বিপুর পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিককে হয়রানি করেন।

শুরু ছাগলকাণ্ডে মতিউরকে দিয়ে: গত বছরের ঈদুল আজহার সময় ছেলের ছাগলকাণ্ডে ঘটনায় সারাদেশে আলোচনার জন্ম দেয় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি। এরপর দুদক অনুসন্ধানে নামলে ঢাকা-নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা একাধিক ফ্ল্যাট-প্লট ও রিসোর্টের খবর প্রকাশিত হয়।

পরে গত ৬ জানুয়ারি ১২৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে দুদক। এর আগে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর মতিউর রহমান ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর শাম্মী আখতার শিবলীর বিরুদ্ধে ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ১২০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে আরও দুই মামলা করা হয়।

দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, মতিউর রহমান ও তার দুই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নামে দায়ের করা পাঁচটি মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (প্রসিকিউশন) ও সাবেক সিনিয়র জেলা জজ মঈদুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, দুদক তার আইন-বিধি অনুযায়ী যেকোনো অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষ করেই প্রাথমিক সত্যতার ভিত্তিতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এনবিআরের যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, দুদক নিশ্চিয় বিধিবিধান প্রতিপালন করেই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে আইন অনুযায়ী অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।