রিজার্ভ চোরের হদিস নেই নেপথ্যে নানা কৌশল

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
০৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রিজার্ভ চোরের হদিস নেই নেপথ্যে নানা কৌশল

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় তদন্তের সময় ৮৬ দফা বাড়িয়েও মূল চোরের হদিস মেলেনি। বিদেশে থাকা হ্যাকার চক্র থেকে তথ্য না পাওয়ায় চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ ছাড়া বাংলাদেশে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিলে যুক্তরাষ্ট্রে দায়ের হওয়া মামলার রায় বিপক্ষে যেতে পারে- এই অজুহাতেও প্রতিবেদন আটকে থাকে দীর্ঘদিন। এ ছাড়া চার দফায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বদলিও তদন্তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর শুরুতে প্রায় এক মাস রিজার্ভ চুরির মতো ভয়াবহ ঘটনাটি গোপন রাখা, তদন্ত রাজনৈতিক প্রভাব, নানা কৌশলে আলামত মুছে ফেলার কারণেও তদন্তকাজ পিছিয়ে যায়। এ সব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ কর্মকর্তাদের চুরির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হতে পারেনি সিআইডি। তবে তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা এবং চুরির তথ্য মুছে ফেলার মতো দায় পাওয়া যাচ্ছে।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের যারা এই অপরাধের জন্য দায়ী, তাদের বিচারের সম্মুখীন করার জন্য করণীয় ঠিক করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। গতকাল তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে সিআইডিকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, রিজার্ভ চুরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা জড়িত আছে, তাদের নাম যেন অভিযোগপত্রে না দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও শ্রীলংকার কাছে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যানস রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) আওতায় সন্দেহভাজনদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তার বড় অংশের উত্তর আসেনি। চলতি সপ্তাহে চীনের ২০ নাগরিকের বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। এমএলএআরের তথ্য পেলেই মামলার চার্জশিটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, উত্তর কোরিয়া, হংকং ও শ্রীলংকার নাগরিকদের নাম এসেছে। রিজার্ভ চুরিতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার গ্রুপ ‘ল্যাজারাস’-এর নাম উঠে আসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের তথ্যে। তবে তাদের কাছ থেকে তথ্য পায়নি বাংলাদেশ। তদন্তে উঠে আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। এসব অনেক চিঠির উত্তর আসেনি।

সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে চীনের ২০ জন নাগরিকের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে সিআইডি। ইংরেজির পাশাপাশি সেই চিঠি চীনা ভাষায় অনুবাদ করে পাঠানো হচ্ছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রেও তথ্য চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হবে। সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এসব দেশের এমএলএআরের উত্তর পেলে দ্রুতই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক নির্দেশনা ও বিভিন্ন ধরনের চাপে রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন দীর্ঘ সময় আটকে ছিল। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক আবদার এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারিশ ছিল। শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য আড়ালের চেষ্টা এবং অসযোগিতাও তদন্ত কার্যক্রম পিছিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে মামলা হয়। বাংলাদেশের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিলে যুক্তরাষ্ট্রের মামলার রায় বিপক্ষে যেতে পারে এই অজুহাতেও প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি দীর্ঘ সময়। এরপর মামলার চার দফা তদন্ত কর্মকর্তার বদলির ফলেও অভিযোগপত্র দ্রুত দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে। বর্তমানে তদন্ত সংস্থা দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য কাজ করছে। তবে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার ওপর আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে।

সিআইডি জানিয়েছে, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সরিয়ে নিয়েছিল হ্যাকাররা। চক্রটি ব্যাংকের লেনদেনের সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা সরিয়ে নেয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে নিয়ে দ্রুত টাকা উত্তোলন করে। পরে বিভিন্ন সময় ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত আনা হয়। তবে এখনও ৬৬ মিলিয়ন ডলার ফেরত আসেনি। চুরির ঘটনার ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি, মানি লন্ডারিং ও সাইবার অপরাধ দমন আইনের ধারায় মামলা করা হয়।

সিআইডি বলছে, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত বলে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে হ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। হ্যাকার চক্রকে তদন্ত সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারায় বাংলাদেশ থেকে তাদেরকে কে কীভাবে সহযোগিতা করেছে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির বিষয়ে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তাব্যবস্থা সংরক্ষণে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে হ্যাকাররা দেশের রিজার্ভের টাকা সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এরপর থানায় মামলা না করে সেই চুরির তথ্য মুছে ফেলা হয়েছিল। অভিযোগপত্রে গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিযুক্ত হবেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়ে নিউইয়র্কে বিচার চলমান। বাংলাদেশে তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা নিলে নিউইয়র্কের বিচারের কোনো সমস্যা হবে কিনা, এই বিষয়টা আমরা নিশ্চিত হতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের ল ফার্মের মতামত নেওয়া হবে এবং তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে গতকাল সিআইডির এক কর্মকর্তা ‘আমাদের সময়’কে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অভিযুক্ত হলে আমেরিকার আদালত বলতে পারে চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ নিজেই জড়িত, মামলায় বিদেশি চক্র দায়মুক্তি পেয়ে যাবে- এমন বলা হচ্ছে। তবে বিষয়টি ভিন্নও হতে পারে। অভিযোগপত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ বিদেশিরা আসামি অভিযুক্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদালতে যদি বিদেশিদের অপরাধ প্রমাণ হয়, তাহলে সেই রায়ের আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ সহজে চুরির অর্থ ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র ও ব্যাংককে চাপ প্রয়োগ করলে তারা দুর্নামের ভয়ে অর্থ ফেরত দেওয়ার পথ খুঁজতে পারেন।

রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ৩ মার্চ আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্ব ছিল তিন মাসের মধ্যে সুপারিশ প্রদান। বর্তমানে চার মাস পেরিয়ে গেছে। তবে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ব্যবস্থা নিয়েছে, এটা আমরা জানতে চেয়েছি। কী ব্যবস্থা নিতে হবে সেটাও বলেছি।

তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমারের বিষয়ে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) সার্ভার একটি সংবেদনশীল ব্যবস্থা। তা সত্ত্বেও গভর্নর সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) সংযোগ করার অনুমোদন দেন। আরটিজিএস একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক তহবিল স্থানান্তর করা যায়। সুইফটের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগ দেওয়ায় হ্যাকিংয়ের বিষয়টি সহজ করে তোলে।

তদন্তে আরও এসেছে, তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর-৪ আবুল কাশেম সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএস সার্ভিস প্রদানের বিপক্ষে ছিলেন। যার কারণে আরটিজিএসের সার্ভিস দেওয়া সংক্রান্ত ফাইল গভর্নর আতিউর রহমান নিজে সই করে অনুমোদন দেন। এ ছাড়া অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি দ্বারা সুইফট সার্ভারের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা এবং রিজার্ভ চুরি হওয়ার পর বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে ক্রাইম সিনে (অপরাধ সংঘটনের স্থানে) এনে অপরাধস্থলের তথ্যপ্রমাণাদি পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়। তদন্তে দেখা গেছে, অপরাধীদের কেউ সার্ভার কক্ষ খোলা রেখে, কেউ ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে, কেউবা অনুপস্থিত থেকে হ্যাকারদের সুযোগ করে দিয়েছেন। রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ২৪ দিন গোপন রেখে এবং ৩৩ দিন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না করে ৩৯তম দিনে গিয়ে থানায় মামলা করার বিষয়টি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিদেশি দুটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ঘটনাস্থলে নিয়ে আসেন। তাদের দিয়ে ক্রাইম সিন থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা পুরোপুরি বেআইনি কাজ। এর মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট হয়ে যায়।

৮৬ দফা সময় চেয়েছে তদন্ত সংস্থা : শেখ হাসিনার সরকারের সময় রিজার্ভ চুরির মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের সময় পেছানো হয়েছিল ৭৫ বার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিবেদন দিতে আরও ৯ দফা সময় নেয় সিআইডি। গত বুৃধবার মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরহাদ কবির তা দাখিল করতে পারেননি। তাই আদালতের কাছে সময় আবেদন করা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক জাকির হোসাইন সিআইডিকে রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আগামী ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছেন।