পিআর পদ্ধতিতে সরকার স্থিতিশীল হবে না

শাহজাহান মোল্লা
০৪ জুলাই ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
পিআর পদ্ধতিতে সরকার স্থিতিশীল হবে না

দেশে ভোটের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) বা আনুপাতিক ভোট। এ পদ্ধতি চালু হলে শাসনব্যবস্থায় কি পরিবর্তন হতে পারে? হঠাৎ কেন এ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা? এর সুবিধা-অসুবিধাই বা কি? এমন সব প্রশ্ন সামনে রেখে চলছে নানা বিশ্লেষণ। বিশ্লেষকদের মতে, এ পদ্ধতি চালু হলে স্থিতিশীল সরকার গঠন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে; বাড়তে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও সংশয় দেখা দিতে পারে।

আবার অনেকে মনে করেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে ভোটারদের মূল্যায়ন হবে। কোনো একটি দল তাদের ভোট ব্যাংককে কাজে লাগিয়ে এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যও সৃষ্টি হবে। কিন্তু দেশের ভোটারদের কাছে এ পদ্ধতি একেবারেই নতুন। এটি চালু হলে পছন্দের প্রার্থী বিজয়ী হয়ে সংসদে যাবেন, সেই নিশ্চয়তা ভোটারদের কাছে থাকবে না বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যার ফলে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যেতে পারে।

এ পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও। কোনো কোনো নেতা বলছেন, যা কিছুই করা হোক সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিকে অবলম্বন করে করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের মালিক। তাদের মতামত ছাড়া যা কিছুই করা হোক গ্রহণযোগ্য হবে না।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, কিছু বামপন্থি ও তরুণ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বাধীন দলগুলো পিআর পদ্ধতির কথা বলে আসছে। যার ফলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এজেন্ডায়ও স্থান পায় পিআর পদ্ধতি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন। সেখানে বিএনপিসহ তাদের মিত্র অনেক দলই এর বিরোধিতা করে। বিএনপি নেতাদের ধারণা, নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল হিসেবে পিআর পদ্ধতি সামনে আনা হয়েছে। তারা মনে করেন, এ পদ্ধতি চালু হলে সরকার আরও স্বৈরতন্ত্রের দিকে যাবে।

তবে জামায়াতসহ কিছু দল মনে করছে, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে কোনো দলের এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবণতা কমবে। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে। বিশেষ করে বিএনপি, আওয়ামী লীগের একক ক্ষমতার হ্রাস টেনে ধরতে এ পদ্ধতি খুবই উপযোগী মনে করেন জামায়াতসহ বেশ কিছু দলের নেতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞদের মতে, পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপযোগী না। এ পদ্ধতি চালু হলে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা বাড়বে। কোনো সরকারই স্থিতিশীল হবে না। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।

পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, সংবিধানে লেখা আছে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। তাই যা কিছুই করা হোক সেই মৌলিক ভিত্তিকে অবলম্বন করেই করতে হবে। প্রজাতন্ত্রের মালিকদের সম্মতি বা অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো সংস্কারই গ্রহণযোগ্য হবে না। জনগণের সম্মতির দিকে খেয়াল না করে পর্দার অন্তরালে যতই ইঞ্জিনিয়ারিং করে একমত হওয়ার নাটক করুক, সেটা খুব নীতিসম্মত হচ্ছে বলে আমি মনে করি না।

প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, একটা জায়গায় শুধু জনগণের সম্মতি নেওয়ার আগেই পরিবর্তন করা উচিত। সেটি হচ্ছে- জনগণের মতামত যাতে যথাযথ হয় অর্থাৎ তাদের প্রতিনিধি যাতে সঠিকভাবে চিহ্নিত এবং নির্বাচিত হয়, তা নিশ্চিত করা। বাকি সবটাই জনগণের মতামত নিয়ে করা উচিত। যেটা করা হচ্ছে, সেটাকে খুবই অগণতান্ত্রিক মনে করি। এখানে জনগণের সম্মতি নেওয়া বা জনগণকে একমত করার বদলে রাজনৈতিক দলকে একমত করার ব্যাপারে সবাই উঠেপড়ে লেগেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, জনগণ সব বিষয়ে একমত হবে সেটা মনে করার কারণ নেই। সে জন্য গণভোট নিতে হবে। সেখানে অধিকাংশ মানুষ কি বলে, সেই অনুযায়ী চলা উচিত।

পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দেশের মানুষ এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত না। এ পদ্ধতি চালু হলে ভোটার যে প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তিনি সংসদ সদস্য হবেন কিনা তা নিশ্চিত না। কারণ যাকে ভোট দেওয়া হলো তিনি যে দলের প্রার্থী, সেই দল যদি সংখ্যাানুপাতে আসন কম পায়, তাহলে সেই দল কোন প্রার্থীকে রাখবেন আর কোন প্রার্থীকে বাদ দেবেন তা একান্তই দলের সিদ্ধান্ত। তাই যাকে ভোট দেওয়া হচ্ছে, তিনি যে এমপি হবেন তার গ্যারান্টি কী? এটা বুঝতে না পারলে ভোটাররা ভোট দিতে যাবেন কেন?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি চালু করা সম্ভব কিনা? এ পদ্ধতি চালু হলে রাজনৈতিক কি গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে? এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য মোটেও উপযোগী না। এ পদ্ধতি দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রচ- সমস্যা সৃষ্টি করবে। ?এ পদ্ধতি চালু হলে স্থিতিশীল সরকার হবে না। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হবে। তাতে দেশের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। অস্থিরতা তৈরি হবে। সত্যিকারের স্থানীয় সরকার কাঠামো যদি থাকত, তাহলে হয়তো সমস্যার কিছুটা সমাধান হতো। কিন্তু সেটা যেহেতু নেই; আগামীতেও হবে বলে মনে হয় না। তাই পিআর পদ্ধতি আমাদের দেশের জন্য অবাস্তব।

পিআর পদ্ধতি দেশকে আরও বেশি স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেবে বলে মন্তব্য করছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার ভাষায়, এতে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।

আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি চালু করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ বিষয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আমাদের সময়কে বলেন, আমরা জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। নিম্নকক্ষে বিদ্যমান পদ্ধিতে নির্বাচন হতে পারে। তবে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত না হয়, সে ক্ষেত্রে এ ইস্যুতে গণভোট হতে পারে। তিনি আরও বলেন, জনগণের ভোটে কোনো দল সরকার গঠন করলেও দেখা যায়, দেশের ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের ওই সরকারের প্রতি সমর্থন থাকে না। কিন্তু জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলো অনেক সময় পরিবর্তন করে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে সরকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- নিম্ন ও উচ্চ উভয় কক্ষে পাস হলেও সংবিধানের মৌলিক বিষয় পরিবর্তনে গণভোট করতে হবে। এমনটি হলে কথায় কথায় সংবিধান পরিবর্তন করে কোনো সরকার ফ্যাসিস্ট হওয়ার সুযোগ পাবে না।

আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কী? কেন এটি নিয়ে এত আলোচনা?

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে। পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে আসনভিত্তিক, ভোটের সংখ্যা ভিত্তিক বা মিশ্র পদ্ধতি- এ তিনটি পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে পার্থক্য কী?

বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০ আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছেন। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেলেন। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলেন ২৫ শতাংশ ভোট।

বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট কোনো কাজে আসবে না। একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করেন তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবেন। অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকল না সংসদে।

সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০ দেশের মধ্যে ৯১ দেশে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।