মুরাদনগরে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড়
কুমিল্লার মুরাদনগরে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবাসীর স্ত্রীকে (২৫) ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিকে ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। বিভিন্ন দল ও সংগঠন নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেছে। এ ছাড়া নারীর বিবস্ত্র ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। পাশাপাশি প্রধান আসামি ফজর আলীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে চলছে তোলপাড়। অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নারীকে নির্যাতনের ভিডিও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীকে (২৫) ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় গত শুক্রবার দুপুরে মুরাদনগর থানায় মামলা করেন ওই নারী। গতকাল পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে ভোরে রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা জেলা পুলিশ। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন বাহেরচর গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে মো. সুমন, জাফর আলীর ছেলে রমজান আলী, আলম মিয়ার ছেলে মো. আরিফ ও তালেম হোসেনের ছেলে মো. অনিক। এই চারজনকে ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৫ দিন পূর্বে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে আসেন ওই নারী। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ফজর আলী (৩৮) নামের এক ব্যক্তি ওই নারীর বাবার বাড়িতে গিয়ে ঘরের দরজা খুলতে টোকা দেন। এ সময় দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানালে একপর্যায়ে ফজর আলী ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওই নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।
ভুক্তভোগী নারীর একাধিক প্রতিবেশী জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ওই বাড়িতে অনেক শব্দ হচ্ছিল। এ সময় তারা ছুটে গিয়ে দেখতে পান দরজা ভাঙা। পরে তারা ওই নারীকে উদ্ধার করেন। এ সময় কিছু লোক ভিডিও করতে থাকেন। পরে তারা বুঝতে পারেন ওই নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। তখন লোকজন ফজর আলীকে মারধর করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় ফজর আলী। পরে শুক্রবার দুপুরে ভুক্তভোগী নারী মুরাদনগর থানায় মামলা করলে শনিবার ওই নারীর বিবস্ত্র ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়।
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগী ওই নারী থানায় মামলা করার পর পুলিশ আসামি গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে। পাশাপাশি ওই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এ ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল আসামি ফজর আলীকে ধর্ষণের অভিযোগে এবং অন্যদের ভিডিও ধারণ ও ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
গতকাল দুপুরে কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. নাজির আহম্মেদ খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনায় অভিযুক্ত ফজর আলী এবং ভিকটিমকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া আরও ৪ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।
এদিকে গ্রেপ্তার ফজর আলীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে তোলপাড় চলছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ফজর আলী বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে বিএনপি থেকে দাবি করা হয়, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য আবদুর রবসহ এলাকার কয়েকজন জানান, ফজর আলী কোনো রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিধারী বা সদস্য নয়। আওয়ামী লীগের আমলে দলটির নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। আর ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতাদের সঙ্গে চলাফেরা করছেন। ইতোপূর্বে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন ফজর। তার বিরুদ্ধে নারী ঘটিত একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তবে রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, এটা স্রেফ একটি পরকীয়া ঘটনা। ফজর আলী ও তার ছোট ভাই শাহপরানের সঙ্গে ওই নারীর দীর্ঘদিন পরকীয়া চলছে।
ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে বিবস্ত্র নারীর ভিডিও ধারণ
পুলিশ বলছে, মুরাদনগরে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী সুমন নেতৃত্ব দেন। ইতোমধ্যে পুলিশ সুমন ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে। এই চারজনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী নারী বাদী হয়ে গতকাল বিকালে মুরানগর থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক একটি মামলা করেন। এর আগে শুক্রবার মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে আসামি করে একই থানায় ধর্ষণ মামলা করেন তিনি।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নিন্দা-প্রতিবাদ
মুরাদনগরের ধর্ষণকা- ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক বেগম সেলিমা রহমান এবং বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী। ওই ঘটনায় নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গতকাল আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, এ ঘটনা শুধু একটি ভয়াবহ অপরাধ নয় বরং নারীর প্রতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ, যা বাংলাদেশের সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে লঙ্ঘন করে। পাশাপাশি এ ঘটনার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। একাধিক অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হলেও এ জঘন্য অপরাধের দ্রুত বিচার এবং সব আসামির কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি। একই ঘটনায় এক বিবৃতিতে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি এবং অবনতির দিকে যাচ্ছে। জবাবদিহিমূলক বিচারিক প্রক্রিয়ার অভাব ও নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করছে।
অন্যদিকে ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীরা। শনিবার রাত ১টার দিকে জগন্নাথ হল থেকে মিছিলটি বের হয়ে রাজু ভাস্কর্য, ভিসি চত্বর হয়ে ফের রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে, আগুন জ্বালো এক সাথে’, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘ছাত্র সমাজের অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’সহ নানা স্লোগান দেওয়া হয়।
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ভিডিও-ছবি সরানোর নির্দেশ
মুরাদনগরের ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সব ধরনের সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন থেকে ভুক্তভোগীর ভিডিও ও ছবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। ওই ঘটনা নিয়ে ‘দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, মামলা’ শিরোনামে গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটিসহ এ নিয়ে অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মীর একেএম নূরুন্নবী আজ রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিকুর রহমান ও তানিম খান এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির।