ঐকমত্য হয়নি ফের আলোচনা
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক চলছে। দ্বিতীয় পর্বে ৭ দিন আলোচনা শেষেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গতকাল রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। গতকালের আলোচনায় নতুন কোনো বিষয় রাখা হয়নি। আগের কয়েকটি বিষয়ে অসমাপ্ত আলোচনা নিয়ে আবার আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা।
আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিপূর্বে সংবিধিবদ্ধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। এ প্রস্তাবে ঐকমত্য না হওয়ায় এনসিসির পরিবর্তে একটি নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয় কমিশন। কিন্তু আলোচনায় এই কমিটির গঠনের পক্ষেও ঐকমত্য হয়নি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সম্পন্ন করতে এনসিসির পরিবর্তে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবকে অধিকাংশ দল স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এখনও যেসব রাজনৈতিক দল একমত হয়নি, প্রস্তাবটিতে কয়েকটি সংশোধনের পর তাদের আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা আশা করছি, তারা পুনর্বিবেচনা করবে। আমরা আশা করছি, পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
অধিকাংশ দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে একমত জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে অনেকগুলো দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির কথা বলেছে। আবার কিছু দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি, জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনা সম্পন্ন করে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের আলোচনায় আরেকটু অগ্রসর হবে বলে অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখবে।
এর আগে বৈঠক শুরুতে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, গত সাত দিনে নানা বিষয়ে অগ্রগতি হলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির জায়গায় আমরা এখনও খানিকটা পিছিয়ে রয়েছি।
মাত্র একদিন পরেই জুলাই মাস শুরু হচ্ছে। এই মাসের মধ্যেই কমিশন জাতীয় ঐকমত্যের একটি সনদে পৌঁছাতে চায় বলেও জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে সবাই মিলে এই সনদে সই করতে পারব। সেটা হবে কিনা, তা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা হয়তো সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। তারপরও আমাদের বিশ্বাস, জুলাই মাসের মধ্যেই আলোচনার একটি পরিণতি টানা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে যদি একমতই হতে হয়, তাহলে সংলাপে ডাকার কারণ কী। এখন যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে আমাদের ১০০ শতাংশ একমত হতে বলে, তাহলে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন।
সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে এমপিরা ভোট দেবে, সেই বিষয়ে একমত হয়েছি। তো ঐকমত্য তো পোষণ হচ্ছে। যে সব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেই বিষয়গুলো একত্রিত করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ সই হওয়ার কথা। তো এখন এখানে যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে, এই সমস্ত বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটা তো সঠিক হলো না।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও নিম্ন কক্ষের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয়ে সংযোজন-সংশোধন করে আজ উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য আগের মতোই। আমরা সাংবিধানিক বিভিন্ন সংস্থা, কমিশন ও সংবিধিবদ্ধ কয়েকটি সংস্থার নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের মতামত আগেই দিয়েছি।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই; বিদ্যমান আইন- যেমন দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়টি এখানে আসছে। বিদ্যমান আইনে অনেক সংস্কার প্রয়োজন। আমরা প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিধান করতে চাই। অন্যান্য কমিশন ও আরও আইনি সংস্থা যদি থাকে, সব বিষয়েই ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে যেতে চাই। কারণ নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ কিংবা আইনসভা- সবক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
তিনি বলেন, নিম্নকক্ষের বিষয়ে, অর্থাৎ বর্তমানে যেটা আমরা জাতীয় সংসদ হিসেবে জানি, সেখানে বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন হয়, জাতীয় কমিশনের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাবে সেটাই বলা হয়েছে। আমরা সেটাতে একমত। হয়তো দু-একটি দলের আলাদা কোনো মতামত থাকতে পারে। এখন এ দুটি বিষয়ই আজ অনিষ্পন্ন রয়ে গেল।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত জুলাই সনদ বলি বা জাতীয় সনদ বলি, সই হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা আমরাই দেখিয়েছি। জাতীয় মূলনীতির ক্ষেত্রে আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি। আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান জানিয়ে সেখানে একমত হয়েছি এবং সেটা জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে। সবাই সেটা একমত হয়েছি। এরপর পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটিগুলোতে বিরোধী দলের কাছে সভাপতিত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা একমত হয়েছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের ক্ষেত্রে যেটা জীবদশায় বা সারাজীবনে কোনো ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বহাল থাকবেন না, সে বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। তবে ওখানে আমাদের একটা শর্ত ছিল যে, এনসিসির মতো বা সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটির মতো কোনো বিষয় এখানে থাকলে আগের প্রস্তাব অনুসারে যেতে হবে আমাদের।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী কমিটির গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তবে এই প্রস্তাবিত সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থার নিয়োগ কমিটি (আগের প্রস্তাবে নাম ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠনে এখনও বিএনপির আপত্তি রয়েছে।
সবাই শতভাগ একমত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ‘প্রায় অসম্ভব’ মন্তব্য করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এই জটিলতা কমানো যায়। প্রস্তাবিত নিয়োগ কমিটি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং এর লক্ষ্য হলো নিরপেক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিদের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিশ্চিত করা।
তিনি আরও বলেন, এই কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার কোনো সংকোচন বা পরিবর্তন হবে না। এসব কমিটি কখনোই প্রধানমন্ত্রীর অধীন ছিল না এবং এক্সিকিউটিভ অংশের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ইনডিপেনডেন্ট কাজ। আগে প্রতিটি কমিটির নিয়োগের জন্য আলাদা সার্চ কমিটি গঠন করা হতো, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের সুযোগ বেশি ছিল। নতুন প্রস্তাবিত স্থায়ী কমিটি এই সুযোগ কমাবে। কেউ কেউ এটাকে ভুল বুঝে বলতে চাচ্ছিলেন যে এ রকম একটা কমিটি থাকলে প্রধানমন্ত্রীর হাত-পা বেঁধে দেওয়া হবে। আসলে এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর হাতও জড়িত নেই, পাও জড়িত নেই।
আব্দুল্লাহ তাহের বলেন, বিএনপির আপত্তি আছে, এ রকম কমিটি গঠন করুক এটায় তারা রাজি না। অধিকাংশ দল, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছে। অধিকতর সংস্কার এবং আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষকে ঐকমত্যে আনা সম্ভব হবে। জাতির স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি এবং এর মাধ্যমে একটি ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ সম্ভব হবে, যা দেশকে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত করে পরিবর্তন আনবে।
এদিকে মৌলিক সংস্কার শেষ না হলে জাতীয় নাগরিক পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, সেটা পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছেন নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এনসিপি শুরু থেকে বলে আসছে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। নির্বাচন আয়োজনের পূর্বে অবশ্যই পালনীয় কিছু বিষয় রয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা, মৌলিক সংস্কারে ভিত্তিতে জুলাই সনদ করা। বিচার কাজ দৃশ্যমান করা এবং নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। যদি অন্তর্বর্তী সরকার এই অবশ্য পালনীয় কাজগুলো করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে সামনের নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কিনা সেটা আমরা পুনর্বিবেচনা করব।
আখতার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়া, ক্ষমতার কাঠামোকে অক্ষুণœ রেখে, সেটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাইব, বাংলাদেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মৌলিক সংস্কারের পথ বের করার। আমরা যদি সংস্কারের প্রশ্নে কোনো একটা জায়গায় ছাড় দিই, তাহলে গোটা জাতির স্বার্থ সেখানে কাটা পড়ে যায়। বাংলাদেশের ’২৪-এর অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটবে, রাষ্ট্রের যে অর্গানগুলো আছে সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ থাকবে। সেই জন্যই মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। আগামী ২ জুলাই ফের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।