এসএমই ঋণ বিতরণে ভাটা
দেশের কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বিতরণে ভাটা পড়েছে। গত বছর এ খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। এ জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় চলমান তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, উচ্চ সুদের হার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিসহ সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া মহামারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠতে না পারার কারণেও ঋণের চাহিদা কমতে পারে বলে জানান তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রায় ৭৮ লাখ সিএমএসএমই রয়েছে। এ খাতে ২ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত। জিডিপিতে অবদান রাখছে প্রায় ২৮ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার, যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার। এসব ইউনিটের ৯৯ শতাংশই সিএমএসএমই। অর্থাৎ, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। তারপরও এ খাতে পর্যাপ্ত ঋণের জোগান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অভিযোগ আছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছোটদের ঋণ দিতে বরাবরই অনীহা দেখায়। এর কারণ ছোট ঋণ ব্যবস্থাপনায় খরচ তুলনামূলক বেশি। সেই সঙ্গে ছোটদের ব্যবসায়িক তথ্য, ডকুমেন্ট ও জামানতের ঘাটতি থাকে। তবে বড়দের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয় না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজম্যান্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এসএমই ও করপোরেট ঋণ এক রকম নয়। করপোরেট ঋণে ব্যাংকাররা যেভাবে চাইবে, সেভাবেই ঋণগ্রহীতারা তা সমন্বয় করতে পারে। কারণ, তাদের কাছে সহায়ক জামানত ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস থাকে। কিন্তু ছোটদের ক্ষেত্রে এসবের ঘাটতি থাকবেই। ফলে ছোটরা ঋণটা কীভাবে চায়, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আরেকটা বিষয়, ছোটরা ঋণ নিয়ে যথাসময়ে ফেরত দেন। অথচ ব্যাংকাররা বড়দের ঋণ দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর কারণ সহজেই টার্গেট পূরণ করা যায়। অনেক সময় বড়দের ঋণ দিয়ে তা এসএমই হিসেবে দেখানো হয়। এ ধরনের লুকোচুরিতে কাক্সিক্ষত বিকাশ হচ্ছে না খাতটির।
জানা যায়, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএমএসএমই ঋণস্থিতি ২৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে এ খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ ও অগ্রিম স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিএমএসএমই ঋণ স্থিতির পরিমাণ ৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। এটি মোট ঋণ ও অগ্রিম স্থিতির ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
রাজধানীতে কিশোরীসহ ২ জনের মরদেহ উদ্ধার
২০২৩ সালে সিএমএসএমইতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণস্থিতির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা বা ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু ২০২৪ সালে সিএমএসএমইতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। ফলে গত বছর ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, গত ৫ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালেই সিএমএসএমইতে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৯ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছর ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালে সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ হয় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২০ সালে এ খাতে ঋণ বিতরণ হয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
সিএমএসএমই ঋণের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার জন্য মহামারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবকে দায়ী করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনায় ছোটরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সময় যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তাও বড়দের কারণে ঠিকমতো পায়নি ছোটরা। এরপর আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে ছোটরা আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি। এর মধ্যেও ঋণস্থিতি ১৯ শতাংশের কাছে পৌঁছানো একেবারেই ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা বলা ঠিক হবে না।
আরও পড়ুন:
নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছে এলডিপি?
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়Ñ বাংলাদেশের এসএমইর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জোগান না থাকা। এ খাতে চাহিদার তুলনায় ঋণপ্রবাহের ঘাটতি প্রায় ২৮০ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের নভেম্বরে আইএফসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে এসএমই ফাইন্যান্স নিয়ে ঢাকায় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও একই পরিমাণ ঘাটতির তথ্য দেওয়া হয়। বর্তমানে এ ঘাটতি আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো বছরই (২০২০-২০২৪) সিএমএসএমইতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। উল্টো গত বছর ঋণ বিতরণ আরও কমেছে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান সৈয়দ আব্দুল মোমেন আমাদের সময়কে বলেন, সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে পিছিয়ে পড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ চাহিদা কমে যাওয়া; বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি; আগস্ট পরবর্তী সময়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে অনাস্থা। এ খাতে ঋণ বাড়াতে কিছু পরামর্শও দেন তিনি।
সৈয়দ আব্দুল মোমেনের মতে, ছোট ঋণ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ থেকে অনেক বেশি সমর্থন ও নির্দেশনা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করা যেতে পারে, যাতে পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার পরও ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। সহজে ঋণ প্রদানে একটি ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাসট্রাকচার (ডিপিআই) প্রয়োজন, যার মাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য যাচাইপূর্বক অর্থায়ন করা যাবে। পাশাপাশি উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি, এসএমই অর্থায়নবান্ধব ইকোসিস্টেম ও নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া সিএমএসএমই গ্রাহকবান্ধব উপযোগী পণ্য ও সার্ভিস চালু এবং জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের সুযোগ বাড়াতে হবে।
এদিকে, গত মার্চের দিকে এক সার্কুলারে আগামীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিএমএসএমই খাতে কী পরিমাণ ঋণ দিতে হবে, তার নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সার্কুলার অনুযায়ী, আগামী ২০২৯ সালের মধ্যে ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতির ২৭ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতি বছর এ খাতে ঋণের পরিমাণ দশমিক ৫ শতাংশ করে বাড়াতে হবে। তবে নারী উদ্যোক্তা খাতে অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা আগের মতোই ১৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সেবা উপখাতের ঋণস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২০ শতাংশ এবং ব্যবসা উপখাতে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৪০ শতাংশ করা হয়েছে। আর ৪০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে উৎপাদনশীল উপখাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা।