সচেতনতার বার্তা দেয় ‘নীলচক্র’
বর্তমানে সাইবার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইন্টারনেট ব্যবহার সহজলভ্য হওয়ায় এবং সবার হাতে স্মার্টফোন থাকায় ছোট-বড় সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে অল্পবয়সী মেয়ে ও নারী। এমন আলোচিত বিষয় নিয়ে সিনেমা ‘নীলচক্র’। দুই বছরে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ১৬ তরুণীর ব্যক্তিগত ভিডিও। এ ঘটনায় পাঁচজন আত্মহত্যা করে। পুরো ঘটনাই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের; উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভিডিওগুলো। এর পেছনে কি বড় একটি চক্র রয়েছে? কী চায় তারা? এমন প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে গেছে পরিচালক মিঠু খানের ‘নীলচক্র’।
দুই কিশোর স্কুল পালিয়ে দেয়াল টপকে সাইবার ক্যাফেতে ঢোকে। সেখানে ওরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সুজি নামের এক বিদেশি মহিলার সঙ্গে চ্যাট করে। এ বয়সে কৌতূহলবশত যা করে আর কি! তারপর একদিন ওরা নিষিদ্ধ সাইটে ঢুকে অ্যাডাল্ট ভিডিও দেখে, যে ভিডিওতে দুজনের মধ্যে একজনের মাকে দেখা যায়, যা ওই কিশোরকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। বলা যায় ওর পুরো পৃথিবী টলে ওঠে। এমন ফ্লাশব্যাক দিয়েই সিনেমার শুরু। এরপর চলে আসে বর্তমানে, যেখানে এক কিশোরীর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়ায় মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। মেয়েটির বাবা সমীর কান্তির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ফজলুর রহমান বাবু। এর পরই পর্দায় আগমন ঘটে ফয়সাল বা আরিফিন শুভর। দেখা যায় তিনি একজন সিঙ্গেল প্যারেন্ট, ঘরের কাজকর্ম করছেন। এক কন্যাশিশুর বাবা তিনি। পরিবারে আরও আছেন তার এক খালা। জানা যায়, শুভ এক সাসপেন্ডেড পুলিশ অফিসার। আসামি রিমান্ডে নিয়ে অতিরিক্ত টর্চার করার কারণে যাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু এই আত্মহত্যার কেস তদন্ত এবং সাইবার ক্রাইমের কেসটার দায়িত্ব দিয়ে তার সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। একদিকে দেখা যায় তরুণীরা ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে ভাইরাল হওয়ার নেশায় মেতেছে। আলোঝলমল শহরের বারগুলোতে রাতের অন্ধকারে তরুণ-তরুণীরা পার্টি করছে, যারা নেট দুনিয়ায় পরিচিত টিকটকার বা অন্যভাবে। নাচ-গান এবং মদ্যপানে উন্মত্ত তারা। সেখানেই যেন অদৃশ্য জাল পাতা আছে, যে জালে আটকে পড়ে অবুঝ তরুণীরা। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে তারা ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সময়ের ভিডিও ধারণ করে রাখে। এরই মধ্যে ঘটনায় নায়িকা বা মন্দিরাকে দেখা যায় এক নাচের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে। রাইমা মানে মন্দিরা বাচ্চাদের নাচ শেখায়। সেই স্কুলে ফয়সাল তার মেয়েকে ভর্তি করে দেয়। পরবর্তী সময়ে আসা-যাওয়া করতে করতে ফয়সাল ও রাইমার মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাইমার ছোট বোন রাইসার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নবাগত ঊর্বি। গল্পে সে টিকটক বানায়। একদিন দেখা হয় রিমন নামের এক পপুলার টিকটকারের সঙ্গে। রিমন মেয়েটির সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভাইরাল করার লোভ দেখিয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। ওরা নিভৃতে সময় কাটায়। সেই সময়ের ভিডিও দিয়ে অপরাধীচক্র মেয়েটিকে জিম্মি করে কুপ্রস্তাব দেয়। ঊর্বি তাতে রাজি না হওয়ায় ভিডিওটি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মেয়েটি। তখন ওর বড় বোন রাইমা ওর পাশে দাঁড়ায়। সে ফয়সালের সহযোগিতা চায়। একই সময়ে ফতুল্লায় এক শিক্ষক তার ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করে সেই ব্যক্তিগত সময়ের ভিডিও ভাইরাল করে দেয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মেয়েটি আত্মহত্যা করে। রাইমা তার ছোট বোনকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিলেও সামাজিক গ্লানি সইতে না পেরে রাইসাও আত্মহত্যা করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসব ঘটনা যারা ঘটায় তারাও একের পর এক খুুন হতে থাকে। কিন্তু এই খুন করছে কে?
আরও পড়ুন:
ফের জুটি হলেন মম-শ্যামল
এটি মূলত থ্রিলার। গল্পে সাসপেন্স আছে। তবে কোথাও কোথাও একটু খাপছাড়া লেগেছে। প্রথম দিকে দর্শক ভাবে সমীর কান্তিই হয়তো তার মেয়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পরে জানা যায় কেউ তাকে দিয়ে এই সন্দেহজনক কাজগুলো করায়। কিন্তু কারণটা যথেষ্ট যৌক্তিক মনে হয় না। ঘটনা জানার পর সমীর কান্তির কী পরিণতি হয় সেটা আর জানা যায় না। টিকটকার রিমনের চরিত্রটা অনেকটা বাস্তবের টিকটকার মানুষের আদলে গড়া। দর্শক সেটা রিলেট করতে পারারই কথা। তবে সাইবার ফাঁদে পড়ে অন্য তরুণীদের মতো ঊর্বিও আত্মহত্যা না করলেই পারত। কারণ এ ধরনের ট্র্যাপে পড়লে ভিক্টিম সাধারণত পরিবারের সাপোর্ট পায় না। সে পেয়েছিল। তাই ওকে বাঁচিয়ে রাখাটাও একটা মেসেজ হতে পারত। পরে সব মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই প্রতিবাদ করে, এটা একটা ভালো মেসেজ ছিল। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ফয়সাল। ফয়সাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ। শুভর অভিনয়দক্ষতা যথেষ্ট বেড়েছে। তার কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ, সংলাপ থ্রোয়িংÑ সবকিছুই এখন পরিপক্ব। নায়িকা চরিত্রে মন্দিরা মোটামুটি উৎরে গেছে। তার অভিনয়দক্ষতা তেমন না থাকলেও চরিত্রানুযায়ী নাচের শিক্ষক হিসেবে ভালো করেছে। সে যে নাচ জানে এটা বোঝা গেছে। ফজলুর রহমান বাবু বরাবরের মতোই ভালো অভিনয় করেছেন। বাকিসহ শিল্পীরাও যার যার ক্ষেত্রে ভালো করেছেন। নবাগত শিল্পী ঊর্বিও ছিল বেশ সাবলীল। ছবির গানের বিশেষ ভূমিকা নেই। তবে ওয়াহিদ বাবুর লেখা, ইমন সাহার সুরে মাশা ইসলামের গাওয়া ‘যেতে যেতে’ শুনতে ভালো লাগে, রাতের ঢাকায় গানটির চিত্রায়ণও বেশ ভালো।
আরও পড়ুন:
মারা গেলেন পরীমনির নানা
সিনেমায় সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবও দেখানো হয়েছে। টুটাং অ্যাপে লাইক পাওয়া আর নেট দুনিয়ায় প্রভাবশালী ইনফ্লুয়েন্সার হওয়ার নেশা যে কতটা মরিয়া হতে পারে, সেটাও দেখানো হয়েছে সিনেমায়। মানে একটি ভালো সিনেমা অনেক সময় সমাজ বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেদিক থেকে ‘নীলচক্র’ সাইবার ক্রাইম নিয়ে নির্মিত একটা ভালো চলচ্চিত্র বলা যায়। সিনেমার গল্প নির্বাচন, নির্মাণশৈলীর জন্য পরিচালক মিঠু খান প্রশংসার দাবি রাখেন। ক্যামেরার কাজ, সাউন্ড কোয়ালিটি, উন্নত প্রিন্ট প্রশংসার দাবি রাখে। ধন্যবাদ ফিল্ম ফায়োস প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকেও। পরিশেষে বলতে চাই, তরুণ প্রজন্মের ছবিটি দেখা উচিত।