বাস্তুচ্যুত মানুষে বিশ্ব সংকটে, চাপে বাংলাদেশ

আরিফুজ্জামান মামুন
২০ জুন ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
বাস্তুচ্যুত মানুষে বিশ্ব সংকটে, চাপে বাংলাদেশ

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরুতে বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২২ মিলিয়নের বেশি, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শরণার্থী সাড়ে ৪৩ মিলিয়ন। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বাংলাদেশে। উখিয়া-টেকনাফ ও ভাসানচরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এসব বাসিন্দা এখন বাংলাদেশের বোঝা হয়ে উঠেছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস সামনে রেখে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীরা এ পরিস্থিতিকে অভূতপূর্ব মানবিক সংকট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এবারের শরণার্থী দিবসের সেই গান ঠিক করা হয়েছে ‘শরণার্থীর সঙ্গে সংহতি’।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যাও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে অন্তত ২ কোটির বেশি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে। তারা শহরমুখী হয়ে নানা ধরনের সামাজিক ও অবকাঠামোগত চাপে ফেলবে প্রশাসনকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাস্তুচ্যুতদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও ট্রমা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তার বার্তায় বলেন, বিশ্ব শরণার্থী দিবসে আমাদের সংহতি কেবল শব্দে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আমাদের এখনই কাজ করতে হবে। মানবিক সহায়তা ও টেকসই সমাধানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, পুনর্বাসনের সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে এবং শরণার্থীদের আশ্রয়ের অধিকারকে সম্মান করতে হবে। চলুন আমরা সংহতি বেছে নিই, সাহস বেছে নিই, মানবতা বেছে নিই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বের বাস্তুচ্যুত জনগণের ৭০ শতাংশের বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করছে; যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, নিরাপত্তা ও জীবিকার মৌলিক সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এ বাস্তুচ্যুত মানুষের একটি বড় অংশ শিশু, নারী ও প্রবীণ যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাস্তুচ্যুত শিশুদের একটি বড় অংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও মানসিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত।

ইউএনএইচসিআররের তথ্য অনুযায়ী, বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে অপেক্ষমাণ রয়েছে। কিন্তু অনেক উন্নত দেশ অভিবাসন নীতিকে আরও কঠোর করে ফেলেছে, ফলে শরণার্থীদের বৈধ আশ্রয় পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শরণার্থী ও অভিবাসীদের জন্য পরিচালিত বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমও বাজেট সংকটে পড়েছে।

এদিকে শরণার্থী সংকটে বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই মানবিক অবস্থান বজায় রেখেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহায়তার ঘাটতি, পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার ধীরগতি, মিয়ানমারের অনীহা ও ক্যাম্পভিত্তিক অপরাধ বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে।

ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, ২০২৫ সালে কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রয়োজন প্রায় ২৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ শতাংশ তহবিল নিশ্চিত হয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দীর্ঘমেয়াদি সংকট শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকুল আবরার বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন আর কেবল মানবিক বিষয় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে রাখা কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও জোরালো পদক্ষেপ দরকার।কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে পুষ্টিহীনতা ও স্বাস্থ্য সংকট এখন মারাত্মক। বিশেষ করে শিশু ও নারীরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। প্রতিবছর বর্ষায় বন্যা, পাহাড়ধস ও অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছরও একটি বড় অগ্নিকাণ্ডে প্রায় দুই হাজার ঘর পুড়ে গেছে। এ ছাড়া মাদকপাচার, মানবপাচার ও সহিংসতা বৃদ্ধির কারণে ক্যাম্প এলাকাগুলো এখন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিকল্প হিসেবে ভাসানচর প্রকল্পে প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করেছে। সেখানে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার মতো আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, এ প্রকল্পকে সফল করতে আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

বিশ্ব শরণার্থী দিবস সামনে রেখে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা যেসব বার্তা দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শরণার্থীদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সংহতি আরও দৃঢ় করতে হবে। আশ্রয়দাতা দেশগুলোর ওপর যে চাপ পড়ছে, তা কমাতে উন্নত দেশগুলোর উচিত অর্থায়ন ও শরণার্থীদের পুনর্বাসনে আরও বেশি ভূমিকা রাখা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ ও রাজনৈতিক জটিলতা থাকলেও শরণার্থীদের সহায়তা থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা দেশ হারিয়ে পথে পথে ঘুরছে, তাদের রক্ষা করা শুধু মানবিক দায় নয়, এটি আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতাও। তারা বলছেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করতে হবে। এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়, আঞ্চলিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুকে জোরালোভাবে তুলে ধরা এবং আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আরও বাড়ানো দরকার।